হাওরের ৪৬ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি পথে

হাওরের ৪৬ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি পথে
নিউজ ডেস্কঃ দেশের মিঠা পানির মাছের অন্যতম উৎস সিলেটের হাওরগুলো থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৬ প্রজাতির মাছ। জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মান, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও অবাধ মৎস্য নিধনের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। একই কারনে কমে আসছে মাছের উৎপাদনও। সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সিলেট বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, দেখার হাওর, শনির হাওরসহ সিলেট বিভাগের হাওরগুলো দেশের মৎস্য সম্পদের অন্যতম আঁধার। দেশের চাহিদার একটি বৃহৎ অংশের মাছ এই হাওরগুলো থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে। এসব হাওরে এক যুগ আগেও প্রায় ১০৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতে। এরমধ্যে গত কয়েক বছরে বেশকিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। আরো কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে অন্তত ৪৬ প্রজাতির মাছ। বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে ২০১১ সাল থেকে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাও একই লক্ষ্যে হাওর এলাকায় কাজ করছে।

সম্প্রতি মৎস্য অধিদফতরের সহায়তায় পরিবেশ অধিদফতরের উপকূলীয় ও জলাভূমি প্রকল্প জরিপ নামে একটি জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এনসিআরএস, আইডিয়া ও প্রচেষ্টা এই জরিপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এই জরিপে দেখা গেছে সিলেটের হাওরগুলোর ১০৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৪৬ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জরিপের ফলাফলে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- মহাবিপন্ন, সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি।

এরমধ্যে মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে- টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙ্গাস, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা। সঙ্কটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে- বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়। এবং বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে- গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালিবাউশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেটে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৫৫৬ হেক্টর হাওর, বিল ও জলাশয় রয়েছে। এসব উৎস থেকে প্রতিবছর প্রায় সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ মেট্রিকটন মাছ আহরণ করা হয়। তবে এক দশক আগে মাছ আহরণের পরিমাণ আরও বেশি ছিল।

সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শঙ্কর চন্দ্র পাল বলেন, এই জরিপে উল্লেখিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে কিছু প্রজাতির মাছ নদীতে ও বদ্ধ জলাশয়ে পাওয়া গেলেও হাওরে আর পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এই তালিকার বাইরেও আরো কিছু প্রজাতি আছে যা এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যেমন চাপিলা মাছ, বালিগড়া, গুতুম, ভেড়া, খাকি, উপল, চেলাপাতা, লাড়িয়া প্রভৃতি।

জরিপকাজ সম্পাদনকারী বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আইডিয়া’র নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক বলেন, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, সেচের মাধ্যমে মৎস্য আরোহন, জলাশয়ে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি, জলবায়ুর পরিবর্তন, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারসহ নানা কারনে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন বাঁধাগ্রহস্ত হচ্ছে। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তিনি বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তিরোধ ও বিস্তারে হাওর অঞ্চলের মৎসজীবীদের মধ্যে সচেতনা সৃষ্টিতে আমরা বিভিন্ন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছি। এরমধ্যে রয়েছে, অসময়ে পোনা মাছ ধরা বন্ধ, মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম বৈশাখ থেকে শ্রাবন মাস পর্যন্ত মৎস্যজীবিদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা ও ভিন্ন পেশা গ্রহণে উৎসাহিত করা, সেচের মাধ্যমে মৎস্য নিধন বন্ধ করা ও মৎস্য আইন সম্পর্কে মৎস্যজীবিদের সচেতন করে তোলা।

এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগের সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক ড. নিত্যানন্দ দাস বলেন, দেশীয় ও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছের চাষ বাড়াতে মৎস্য বিভাগ থেকে ‘চিহ্নিত অবক্ষয়িত জলাশয় উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং দেশীয় প্রজাতির ছোট মৎস্য সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৮১ লাখ টাকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা অবমুক্ত ও নার্সারি স্থাপন করে মাছের প্রজাতি সংরক্ষনের চেষ্টা করা হচ্ছে। নিত্যনন্দ দাস বলেন, ডিমওয়ালা ও পোনা চাষ নিধন থেকে বিরত রাখতে বৈশাখ থেকে শ্রাবন মাস পর্যন্ত মৎস্যজীবিদের মধ্যে ভিজিএফ চালুরও পরিকল্পনা আছে। এই চার মাস যে কোনো উপায়ে মাছ নিধন থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করা হচ্ছে।তিনি বলেন, আমাদের মৎস্যজীবিরা প্রশিক্ষিত না। তাদের মৎস্য চাষ ও আরোহনের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া মৎস্য আইন প্রয়োগেও এখন অনেক কঠোরতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘মাছের উৎপাদন ও বিলুপ্তি ঠেকাতে হাওরের জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মা মাছের নির্বিঘ্নে বড় হওয়া ও প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি উন্মুক্ত জলাশয়, বিল ও নদীতে অভয়াশ্রম স্থাপন করা প্রয়োজন। এক কথায় মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ বিচরণস্থল তৈরি করতে না পারলে কোনোভাবেই মাছের বিলুপ্তি রোধ করা সম্ভব হবে না।’

Post a Comment

Previous Post Next Post