কুলাউড়ায় ইউপি নির্বাচনে চলছে শেষ মুহূর্তের হিসেব নিকেশ;
ভূকশীমইল, জয়চন্ডী, বরমচাল, রাউৎগাঁও ইউপি
এস আলম সুমনঃ ৩য় ধাপে আগামী ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে কুলাউড়া উপজেলার সাত ইউনিয়নে শেষ মুহূর্তে কোন প্রার্থী কতটুকু এগিয়ে আছেন চলছে তার কাউন্ট ডাউন। ইতোমধ্যেই প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটররা হিসেব কষতে শুরু করেছেন। এবারের ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। চেয়ারম্যান পদে আ’লীগ ও বিএনপিতে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী ও বর্তমান চেয়ারম্যানরা দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। মনোনয়ন বঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় অনেক দলীয় প্রার্থী বিপাকে রয়েছেন। দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিদ্রোহীদের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে কোন দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে আলোচনা সমালোচনা। সরেজমিনে ভূকশীমইল, জয়চন্ডী, বরমচাল, রাউৎগাঁও ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে দেখা যায় প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণায় এ সকল এলাকার লোকজনের মধ্যে উৎসবের আমেজ। শেষ মুহূর্তে প্রার্থীরা জনসমর্থন আদায়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কৌশলে। জনমত জরিপের জন্য কথা হয় এলাকার সাধারণ ভোটারদের সাথে। ভূকশীমইল, জয়চন্ডী, বরমচাল, রাউৎগাঁও ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ১৫জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে আ’লীগের ৪, বিএনপির ৪, বিএনপি-আলীগের বিদ্রোহীসহ স্বতন্ত্র ৭ জন প্রার্থী।
জয়চন্ডী ইউপি: এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুর রব মাহবুব (নৌকা), বিএনপির বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী কমর উদ্দিন আহমদ কমরু (আনারস), বিএনপির প্রার্থী রুমেল খান (ধানের শীষ), (স্বতন্ত্র) প্রার্থী আব্দুল জলিল (চশমা) প্রতীকে এই চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইউনিয়নের পুষাইনগর, রামপাশা, গ্রামের গিরিন্দ্র দাস, আহমদ আলী মো. মখলিছ মিয়া, মইন মিয়া, আলতা মিয়াসহ কয়েকজন ভোটার জানান আমাদের কছে প্রতীক কিংবা দল বড় নয় প্রার্থী বড়। যাকে আমরা সবসময় কাছে পাই তাকেই ভোট দিব। মীরশংকর, ভৈরবগঞ্জ এলাকার হাবিবুর রহমান, জালাল আহমদ, সরাফত আলী, হায়াত আলী, আসাদ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, আমরা কৃষি কাজ করে খাই প্রতীক কিংবা দল নয় কৃষকদের জন্য যে কাজ করবে তাকেই ভোট দিব। বিজয়া বাজার এলাকায় কথা হয় হবিব মিয়া, কনু মিয়া, তৈয়ব আলী, মুজিব, গিয়াস ও রুবেল আহমদের সাথে তাঁরা বলেন এলাকার উন্নয়নে যে বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাকেই ভোট দিব। এদের মধ্যে কয়েকজন বলেন সরকার দলীয় প্রার্থী নির্বাচিত হলে এলাকার উন্নয়ন বেশি হবে। বিজয়া চা বাগানের কিশান পাশি, বিরেন্দ্র লায়েক, বিমল দেবসহ বেশ কয়েকজন চা শ্রমিক বলেন আমরা চা বাগানে কাজ করি, “কাকে ভোট দিমু এটা বলে লাভ কি? আমরা যাকেই ভোট দেই না কেন, সবাই মনে করে আমরা নৌকায় ভোটা দেই”। এবারই নতুন ভোটার হিসেবে ভোট দিবেন চা শ্রমিক সন্তান শিক্ষার্থী লালন গোয়ালা ও পিন্টু পাশি, তারা বলেন দক্ষ এবং চা শ্রমিকদের কল্যাণে যিনি কাজ করবেন এমন প্রতিনিধি চাই। গিয়াসনগর গ্রামের শতবর্ষী সাদ উল্ল্যা বলেন, ‘আর কত দিন বাঁচমু, জীবনর শেষ ভোটটা যেন ভালা মানষরে দেই’। দক্ষিণ কামার কান্দি এলাকার কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজের দুই শিক্ষার্থী সজিব, রিপন এবং স্থানীয় বাসিন্দা গনি মিয়া, আমেনা বেগম বলেন দল ও প্রতীক দিয়ে কি হবে য্যেগ্য ব্যক্তি প্রতিনিধি না হলে এলাকার উন্নয়ন সম্ভব না। চা বাগান অধ্যুষিত এ ইউনিয়নে চা শ্রমিকদের রায় যার পক্ষে থাকবে ভোটযুদ্ধে তিনি অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন বলে স্থানীয়দের ধারণা। এলাকার ভোটারদের ভাষ্যমতে প্রথমদিকে বর্তমান চেয়ারম্যান কমর উদ্দিন আহমদ এগিয়ে থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে জনসমর্থন আদায়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহবুব অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন। এই দু’জনের মধ্যে মূল লড়াই হবে।
ভূকশীমইল ইউপি: হাকালুকি তীরবর্তী এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রেনু (নৌকা), বিএনপি প্রার্থী প্রভাষক আজিজুর রহমান মনির (ধানের শীষ), জাময়াত সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আতিকুর রহমান (আনারস) প্রতীকে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন। ইউনিয়নের কুরবানপুর, গৌড়করণ মহেশগৌরী গ্রামের ফারুক আহমদ, সাহেদ, জামাল আহমদ, ফরুখ মিয়াসহ স্থানীয়রা বলেন, কে কোন দলের নেতা সেটা দেখে নয় যোগ্য প্রার্থীকেই নির্বাচিত করতে চাই। কানেহাত ভ’কশীমইল, বাদে ভ’কশীমইল, জাব্দা গ্রামের রশিদ, আব্দুল লতিফ, মোশররফ আহমদ, আব্দুল মজিদ, আসিদ মিয়া, ছোটন মিয়া, রুজেল আহমদ, জাহেদ, সামছুল ইসলাম, রুম্মানসহ বেশ কয়েকজন জানান হাওর পাড়ের মানুষের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাস্তাঘাটের উন্নয়নে যিনি কাজ করবেন তাকেই ভোট দিব। এজন্য এবার পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষার্থী মোঃ. আশফাক আফজাল, লুৎফুর তালুকদার ও রাজু আহমদ বলেন জীবনের প্রথম ভোট তাই বোঝেশুনে এলাকার উন্নয়নের জন্য সৎ ও দক্ষ দেখে ভোট দিব। মৎস্যজীবী অধ্যুষিত মীরশংকর (একাংশ) ও সাদিপুর গ্রামের কয়েছ আহমদ (বটলাই), কাজল, আব্বাছ, বাবুল, রসিম মিয়া, লেবু বলেন, আমরা বছরে ৬/৭ মাস হাওরে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাই, বাকি সময় বেকার থাকি এসময় বিকল্প কাজের সুযোগ করে দিবেন এমন চেয়ারম্যান চাই। আমাদের বিপদ আপদে সবসময় যিনি কাছে থাকবেন তাকেই ভোট দিব। এলাকার ভোটারের ভাষ্যমতে আলীগের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন বিএনপি প্রার্থী আজিজুর রহমান মনির। চমক দেখাতে পারেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রেনু এলাকায় নিজের বলিষ্ঠ অবস্থান ও সমর্থন কতটুকু টিকিয়ে রাখতে পারেন সেটি নির্বাচনেই স্পষ্ট হবে।
বরমচাল ইউপি: এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের প্রার্থী উপজেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল আহবাব চৌধুরী শাহজাহান (নৌকা), বিএনপির আব্দুল মোক্তাদির মুক্তার (ধানের শীষ), বিএনপির বিদ্রোহী বর্তমান চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান (আনারস), আ’লীগের বিদ্রোহী মোঃ. জামাল হোসেন (চশমা) প্রতীকে এই চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। স্থানীয় ভোটার উত্তরভাগ গ্রামের আব্দুল ওদুদ, রহিম মিয়া, গিয়াস আহমদ দবুর আলী, সোনা মিয়াসহ বেশ কয়েকজন জানান, দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি যোগ্য ব্যক্তিকে তাঁরা ভোট দিবেন। ফুলেরতল বাজার ও অকিলপুর এলাকার জাহেদ চৌধুরী, মুনির, ব্যবসায়ী মজিদ, হোসাইন আহমদ, তানভীর বলেন, এলাকা ও জনগণের কল্যাণের বিষয়ে যিনি গুরুত্ব দিবেন তাকেই ভোট দিবেন। সিঙ্গুর মোকাম বাজারে কথা হয় মিছাবাহ আহমদ, মানিক মিয়াসহ বেশ কয়েকজন ভোটারের সাথে, তারা বলেন সরকার দলীয় প্রার্থী নির্বাচিত হলে ইউনিয়নের উন্নয়ন বেশি হবে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় আব্দুল মুক্তাদির বিএনপির দলীয় প্রার্থী হওয়ায় বর্তমান চেয়ারম্যান থাকা স্বত্বেও ইছহাক চৌধুরী ইমরান অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন। এদিকে বিএনপির দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় এবং আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তেমন শক্তিশালী না হওয়ায় অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন সরকার দলীয় প্রার্থী আব্দুল আহবাব চৌধুরী শাহজাহান। এখানে আলীগের প্রার্থী, বিএনপির প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যানের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা।
রাউৎগাঁও ইউপি: এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জামাল, বিএনপির প্রার্থী আব্দুল মোহিত সোহেল (ধানের শীষ) ও আ’লীগের প্রার্থী আকবর হোসেন সোহাগ (নৌকা), স্বতন্ত্র এনামুল হক মাহতাব (ঘড়ি) প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইউনিয়নের মনরাজ, ভবানীপুর, রাউৎগাঁও, নর্তন, আমতলা বাজার, চৌধুরীবাজার এলাকার শফি চৌধুরী পলিট, মুবিন সুমন, শাহিন খান, জমির মিয়া, উস্তার আলী, মিজানসহ স্থানীয়রা জানান, এখানে নির্বাচনে দ্বিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন ভোটার বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান হিসেবে আব্দুল জলিল জামালের ভোট ব্যাংক রয়েছে। তিনি বিএনপির দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় বিএনপির প্রার্থী আব্দুল মোহিত সোহেল অনেকটাই বিপাকে রয়েছেন। তাছাড়া সোহেল প্রবাসী হওয়ায় এলাকার জনগণের সাথে সম্পর্ক গত পাঁচ বছর সম্পর্ক কম থাকায় অনেকটাই ব্যাকফুটে রয়েছেন। এদিকে আকবর হোসেন সোহাগ এবার আ’লীগের প্রার্থী হওয়ায় আলোচনায় চলে এসেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপির বিদ্রোহী ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এমনটাই অভিমত স্থানীয়দের।