জাকির আহমেদ চৌধুরী: বিশ্বজুড়ে করোনার তাণ্ডব চলছে। করোনা সংক্রমিত হয়ে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর পরিসংখ্যান যেমন লম্বা তেমনি আক্রান্তের সংখ্যাও সুখকর নয়। তবে আশার কথা হলো করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আলমাছ খান। দীর্ঘদিন ধরে বৃটেনে থাকেন। গত মার্চ মাসে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃটেনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সম্প্রতি টেলিফোনে তিনি তার করোনা জয়ের গল্প শুনিয়েছেন। পাঠকদের জন্য সেই গল্প তুলে ধরা হলো।
আলমাছ বলেন, আমার লন্ডনে তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে, আমি প্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রতিদিনই সময় দিতে হয়। প্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রতিদিন অনেক লোক আসে। গত ২৭শে মার্চ আমি ফ্রান্স থেকে ঘুরে বৃটেন আসি। এর পরই আমার গলায় ব্যথা শুরু হয়। বিষয়টিকে আমি বেশি গুরুত্ব দেই নাই। পরে অবশ্য গলা ব্যথা কমে যায়। তবে গলা ব্যথা থাকা অবস্তায় আমার পায়ের হাঠুতে, হাতের কব্জিতে ব্যথা অনুভব করি। যখন আমার শরীরে করোনার উপসর্গ আসে তখন আমি ভেবেছি আমার প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য যে কাজকর্ম করি তার জন্য হয়ত এইরকম ব্যথা অনুভব করছি। পরে বুঝতে পারলাম রোগটা আমার গলায় থাকেনি গলা থেকে ফুসফুসে চলে যায়।আমার যখন মনে হয়েছে আমার শরীরের করোনার লক্ষন তখন আমি এন এইচ এ কর্মরত খালাতো ভাই ডা: আলী জাহান ভাইয়ের পরামর্শে ৯ দিন বাসায় থাকার পর অবস্তার অবনতি ঘটে। পরে তারই পরামর্শে “রয়েল লন্ডন হসপিটাল” ভর্তি হলাম ।ডাক্তার পরীক্ষা করে পরের দিন রেজাল্ট দিলেন আমার করোনা পজেটিভ। খবরটা শুনে মনটা ছোট হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম এখন কেউ আমাকে দেখতেও আসতে পারবে না। আল্লাহর দরবারে দোয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। বেচেঁ থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিলাম। অবস্থা খারাপ দেখে আমাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে আল্লাহর কালাম আর রাসুল (সা:) উপর দূরুদ পড়তে লাগলাম। পরেরদিন মোবাইল ফোনে ফেইসবুক খুলে দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমার জন্য স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা দোয়া করছেন। সবার দোয়ায় একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলাম। যেন বাঁচার আশা বাড়তে থাকলো। তারপর আইসিইউ থেকে আমাকে ৪ জনের একটি রুমে নেওয়া হলো। সেখানে আমি ছাড়া বাকি সবাই চোখের সামনে মারা গেলেন। চোখের সামনে তাদের মৃত্যু দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। ডাক্তারকে বললাম আমাকে এই রুম থেকে অন্য রুমে নেওয়া যায় কি না? ডাক্তার ডেভিড সিমকক অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলেন। প্রথমদিন থেকে সে ও তার টিম আমাকে এমনভাবে চিকিৎসা দিয়েছে, মনে হয়েছে তিনি আমার খুব আপনজন। সবসময় সাহস দিতেন মনবল বাড়াতেন। আমার জন্য তিনি রুম পরিবর্তনের ব্যবস্তা করে দিলেন।যতদিন হসপিটালে ছিলাম প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সেবা পেলাম। ৬ দিন পর ডাক্তার বিনয়ের সুরে বললেন, যদি আমাকে ওষুধ দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়, তাহলে তারা অন্য রোগীর সেবা করতে পারবেন। আর কোনো অসুবিধা হলে ফোন দেয়া মাত্র তারা বাসায় চলে আসবেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন বাসায় কিছুদিন থাকলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবো।
তিনি বলেন, করোনার লক্ষণ আসার পর খালাত ভাইয়ের পরামর্শে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে কোয়ারেন্টিনে চলে যাই। যতদিন আমি কোয়ারেন্টিনে ছিলাম তার পরামর্শ মত লেবুর রস, রং চা খেয়েছি। কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় ৮দিনের মাথায় জ্বরসর্দি, ডায়রিয়া, কাশি অনুভব করি। খালাত ভাইয়ের পরামর্শ মত হাসপাতালে ভর্তির জন্য অ্যাম্বুলেন্স কল করি। অ্যাম্বুলেন্স কর্তৃপক্ষ জানায় গাড়ি আসতে চার ঘন্টা সময় লাগবে। কিন্তু তখন আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার ৪ ঘন্টা বাসায় থাকা অসম্ভব হবে। তখন আমি আমার খুব কাছের এক বন্ধুকে ফেন দেই। আমার করোনা পজিটিভ শুনে সে আমার ফোনে সাড়া দেয়নি। পরে আমার চাচাতো ভাই আমার সাথে একই বাসায় থাকতো। তাকে ডেকে বলি আমার গাড়ি বের করার জন্য। আমার বাসা থেকে হাসাপাতালের দূরত্ব ১কিলোমিটার। তাই আমি নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে যাই। সাথে আমার চাচাতো ভাইও গিয়েছিল । হাসপাতালে যাওয়ার পথে আমার ৪বার বমি হয়। আমার চাচাতো ভাই ধরে ধরে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যায়। ইমারজেন্সিতে যাওয়ার সাথে সাথে আমার শরিরের অবস্তার অবনতি দেখে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। আইসিইউতে নেওয়ার আগে তারা দুইটি ইমার্জেন্সি নাম্বার নেয়।
তিনি বলেন, হাসপাতালে সেবার মান দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমার চিকিৎসা ব্যয়ভার সম্পূর্ণ সরকার বহন করেছে।
যারা এখনও আক্রান্ত হননি তাদের উদ্দেশ্যে আমার বার্তা হলো যদি আপনার করোনা উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে আপনি প্রথমেই কোয়ারেন্টিনে চলে যান । আর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা নিন। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হন।