কুলাউড়া জালালীয়া মাদ্রাসার পরিস্থিতি আবারো উত্তপ্ত


বিশেষ প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান জালালীয়া দাখিল মাদ্রাসার পরিস্থিতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগে অপসারিত মাদরাসার সুপার মাওলানা আব্দুস শহীদকে আবারো স্বপদে বহালের পায়তারায় লিপ্ত রয়েছেন স্থগিত ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ ও তাঁর অনুসারী শিক্ষকরা। যৌন হয়রানীর মামলায় জেল খাটা সুপারকে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনার জন্য আব্দুর রউফ, মাদ্রসার শিক্ষক ও কেরানীর চক্রান্তের ফোনালাপ ফাঁস  হওয়ার পর স্থানীয় এলাকাবাসী এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে যৌনহয়রানির অভিযুকক্ত সুপারকে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনার অপচেষ্টার প্রতিবাদে শনিবার ১৪ মার্চ সকালে উপজেলার সদর ইউনিয়নে অবস্থিত জালালীয়া দাখিল মাদ্রাসার সম্মুখে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী এবং মাদ্রাসার সাবেক ও বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ। মানববন্ধনের এক পর্যায়ে মাদ্রাসায় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের রুপ নেয়। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমান ও সুপার আব্দুস শহীদের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মুজিবুর রহমান, শিক্ষক আব্দুছ ছালাম, শিক্ষক আব্দুছ সামাদ ও করণিক আলাউদ্দিন আহমদ এই ৪জন আহত হন। এতে মাদ্রাসার পরিস্থিতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আনোয়ারকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।

সরেজমিন মাদ্রাসায় গেলে জানা যায়, মাদ্রাসার স্থগিত কমিটির শিক্ষানুরাগী সদস্য সুয়েব আহমদ, সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদের শ্যালক এলাইছ মিয়া, সিএনজি চালক শাহীন আহমদসহ প্রায় ১০-১২ জন লাঠিসোটাসহ ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমানের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তখন তিনি আত্মরক্ষার্থে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করেন। পরে তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে কুলাউড়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। এসময় বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ও মাদ্রাসার সাবেক- বর্তমান শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপারের কক্ষে ভাংচুর চালায় এবং একটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করা হয়। তবে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই বলেন, মাদরাসার করণিক আলাউদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত সুপারের ওপর দোষ চাপাতে নিজে তাঁর লোকজন দিয়ে সাইকেল ভাংচুর করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায় , মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত সুপার মাওলানা আব্দুস শহীদ দুই মাস কারাবরণ শেষে বৃহস্পতিবার জামিনে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন আগে সুপার শহীদকে ফের দায়িত্বে আনার জন্য এবং নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি গঠনসহ নানা পায়তারায় লিপ্ত হন মাদ্রারাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ, সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদ, করণিক (কেরানী) আলাউদ্দিন আহমদসহ একাধিক ব্যাক্তি। এজন্য মোবাইল ফোনে আলাপের মাধ্যমে সব ছক তৈরী করেন। পরবর্তীতে সেই ফোনলাপগুলো ফাঁস হয়।

ফোনলাপে অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ বলেন ‘মাদ্রসার শিক্ষক আব্দুছ সামাদকে নির্দেশ দেন একটি মেয়ে রয়েছে। তাকে মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে হবে। সময়মত তাকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মুজিবুর রহমানকে হেনস্তা করানো হবে।

তখন শিক্ষক সামাদ বলেন, স্যার কিভাবে কি করবো, সব কাগজপত্র তো মুজিবুর রহমানের কাছে। তখন আব্দুর রউফ বলেন, মুজিবুর কিছু করতে পারবে না, তোমরা একটু ধর্য্য ধরো। তুমি মাদ্রাসার করণিক আলাউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করো। সে ভর্তি করবে। আবার আরেক প্রশ্নে সামাদ বলেন, স্যার সুপার হুজুরের জামিনের কোন ব্যবস্থা করা যাবে কি। তখন রউফ বলেন, খুব শীঘ্রই তার জামিন হবে।

আরেক ফোঁনালাপে শিক্ষক সামাদ ও করণিক আলাউদ্দিনের মাদ্রাসা নিয়ে কথা হয়। সামাদ বলে সুপার শহীদকে অপসারণ করার জন্য বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার দৌঁড়ঝাপ করছেন। তখন আলাউদ্দিন বলে, শহীদ হুজুরকে নয় বর্তমান সুপার মুজিবুরকে সাসপেন্ড করবো।

ফোনালাপে আরো শোনা যায়, উপজেলা প্রশাসন কিভাবে কমিটি বাতিল করবে, যেখানে কোন সভাপতি, সম্পাদক, এডহক কমিটি নেই। তখন আব্দুর রউফ বলেন, সুপার শহীদ জেল থেকে বের হয়ে আসলে আমরা সবাই বসে সভা করে মুজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করবো। তুমরা একটু ধর্য্য ধরো।’

ফোনলাপের কথা শুনে গত ১১ মার্চ মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মুজিবুর রহমান কুলাউড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। ডায়েরি নং- ৫৬৫।

এদিকে মানববন্ধনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের খবর পেয়ে কুলাউড়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়ারদৌস হাসান মাদ্রাসায় যান। এসময় মাদ্রাসার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরেয়ে না আনা পর্যন্ত মাদ্রাসার সাবেক সুপার মাওলানা আব্দুস শহীদ, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা  মুজিবুর রহমান, সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আব্দুস সামাদ ও করণিক আলাউদ্দিন আহমদকে মাদ্রাসায় না আসতে নির্দেশনা দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী। 
মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুছ সামাদের কাছে মোবাইলে ফোনালাপের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কোন সুদুত্তর না দিয়ে বলেন, এব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবোনা । আমি অসুস্থ পরে কথা বলবো।

মাদ্রাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ জানান, ‘দুই মাস ধরে আমি মাদ্রাসার ধারে কাছে নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনকে বলা হয়েছে, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে। ফোনলাপের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে পারেই তাই বলে কি সবকিছু কি সঠিক। আমি চাই প্রশাসনের সহযোগিতায় এলাকার সবাইকে নিয়ে মাদ্রাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক।’ 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। শিক্ষকদের মধ্যে অনেক ত্রুটি রয়েছে। মাদ্রাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে তদন্তক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post