'পীর বাবার লালাপড়া এবং অবুঝ ভালোবাসা' - ডা. সাঈদ এনাম

পীর বাবার লালাপড়া এবং অবুঝ ভালোবাসা


ডা. সাঈদ এনামঃ ছোট ছিমছাম গড়নের বাচ্চা একটা মেয়ে বার বার চেম্বারের পর্দা উল্টিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো আর ফিসফিস করে এসিস্ট্যান্ট এর কাছে জানতে চাইছিলো তার সিরিয়াল আসছে কিনা, কেমন দেরী? এসিস্ট্যান্ট ও শান্তনা দিচ্ছিলো প্লিজ বসুন, এই যে একটু পর, এইতো শেষ আরো তিন জন...এইতো শেষ আপু...আর একজন....।
আমি বুঝলাম অযথা তাড়াহুড়া করা মেয়েটি হয়তো জেনারেল এনজাইটির পেসেন্ট। চেম্বারে এসে যে সমস্ত রোগী খুব তাড়াহুড়া করেন তাদের বেশির ভাগই দেখা যায় তাদের রোগ নিয়ে টুকটাক এনজাইটিতে ভুগেন। তাই তারা চেম্বারে এসে স্থীর আর থাকতে পারেন না। পায়াচারী করেন। উটবস করেন। এতো দেরী..., এতো দেরী... ডাক্তার সাহেব কই... ইত্যাদি বলে বলে অস্থির করে তুলেন সবাইকে।
যাক একসময় মেয়েটির সিরিয়েল আসলো। সে তার মা সহ বসলো আমার সামনে।
হালকা ছিপছাপ গড়নের চপল চঞ্চল ফর্সা মেয়ে। আমি এক মিনিট তার দিকে তাকলাম। কি ব্যাপার! এতো তাড়া কিসের তার। 
সাইকিয়াট্রিস্ট দের রুগীর "মুড এন্ড এফেক্ট" বুঝতে রোগী দের ফেইস রিড করতে হয়। কেবল সাইকিয়াট্রিস্ট নয় সকল চিকিৎসক দের রোগী দেখার শুরুর প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রথমে এক নজর তাকিয়ে রোগী টা কে দেখা। রোগী এক্সামিনেশন এর এ পর্যায় কে বলে ইন্সপেকশন।
চিকিৎসা বিদ্যার ছাত্রদের সকল ক্লিনিক্যাল এক্সাম গুলোর একটা বোর্ডে ভাইবা শুরু হয় ইন্সপেকশন দিয়ে।
ইন্সপেকশন, পালপেসন, পারকাসন, এন্ড আসকালটেসন। যে কোন পরীক্ষার উত্তর দেয়ার প্রধান কয়েকটি ধাপ। রোল অব থাম্ব। পরীক্ষার হলে প্রতিটি পরিক্ষার্থীদের পাশ করার জন্যে এই ধাপ ফলো করে এগুতে হয়। পরীক্ষক ও চিলের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন এটি ফলো করছে কিনা!
তার আগে প্রফেসর সারা হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে বাছাই করে যে কোন একটা বেড থেকে আচমকা এক রোগী কে সিলেক্ট করে, পরীক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থিনী'র সামনে এনে হাজির করবেন। শুরু করো, বলে পাঁচ মিনিট সময় দিবেন। তারপর স্যার রা ছাত্রকে নিয়ে শুরু করবেন খেলা। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। যতক্ষন না ছাত্রটি আটকেছে। এরি মধ্যে আমল নামায় লেখা হয়ে যায় 'প' আকার পাশ নাকি ফেল।
যাদের প্রিপারেশন ভালো, যারা হাসপাতালের সকল ওয়ার্ড চষে বেড়িয়ে রোগী দেখে, তারা ধুম ধাম চার ছক্কা পিটিয়ে খেলায় জিতে পাশ দিয়ে চলে যায়, আর যাদের প্রিলারেশন "নট আপ টু দা মার্ক", স্যার রা হাসি মুখে ভাইবা বোর্ডেই তাদের কিছুটা পড়িয়ে দেন। ভাইভা তে ধমক খেলে বুঝতে হবে পাশ, আর হাসি মুখে বাপজান টাপজান বলে আদর করে টেবিলে রাখা বিস্কুট, পানি, চানাচুর ইত্যাদি অফার করে খাইয়ে দিলে বুঝে নিতে হবে, নট আপটু দা মার্ক। আমল খারাপ। তাদের কপালে, 
"ধন্যবাদ ফের আবার দেখা হবে,বিজয়ে"।
যাই হোক বলতে চাচ্ছিলাম ইন্সপেকশন এর কথা। কখনো কখনো ভালো ইন্সপেকশনেই রোগীর ডায়াগনোসিস এ পৌছা যায়। একে বলে সার্প ক্লিনিক্যাল আই।
সাইকিয়াট্রিতে ফেইস ইন্সপেকশন খুবই গুরুত্ব পুর্ন। ফেইসে "মুড এন্ড এফেক্ট" টি দেখতে হয়। অনেক রোগ আছে যা চেহারায় ছাপ ফেলে। চেহারাতে অনেক রোগের লক্ষন সুপ্ত থাকে । এই যেমন, একজন ম্যানিক মহিলা রোগীর ফেইসের দিকে তাকালে দেখা যাবে তিনি কটকটে কড়া লাল, নিল কিংবা হলুধ লিপস্টিক লাগিয়েছেন, সেই সাথে থাকবে তার কটকটে রংমেশানো ম্যাচিং অর নন ম্যাচিং মেকাপ উইথ গেট আপ।। বাহারি রং চং এর গহনাও থাকবে সাথে। কথা বার্তা হবে অনেক অনেক বেশি। গোছালো কিংবা অগোছালো।
আবার ডিপ্রেশন এর পেশেন্ট এর থাকবে পুরো উলটো। এদের চেহারা টা থাকবে মলীন। কপালে থাকবে ভাঁজ। কথা বার্তায় একেবারে ঠান্ডা।
আবার একজন পারকিনসন্স রোগীর ফেইস ধরা যাক। উনাকে দেখলে বুঝা যাবে না যে, উনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন বা বুঝাতে চাচ্ছেন। সেটাকে মেডিকেলের ভাষায় বলে এক্সপ্রেশন লেস ফেইস। মানে এক্সপ্রেশনটি কি, তা ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা।
ফেইস দেখে প্রথমেই অনেক গুলো রোগ নির্ণয় করতে পারেন ভালো মানের একজন বিশেষজ্ঞ। এগুলো চিকিৎসা বিদ্যার বইয়ে খুব সুন্দর করে লিখা। একটা কোয়েশ্চন আছে, হোয়াট ইস দা ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনোসিস অব এন "এক্সপ্রেশন লেস" ফেইস।
যাক গে, ছিপছিপে হালকা গড়নের লাউ গাছের ডগার মতো বাড়ন্ত ছোট্ট মেয়েটির ফেইস ইন্সপেকশন এ আমার চোখে বড় যে গলতি ধরা পড়লো সেটা হলো তার কপালে একটি চিকন পোড়া দাগ। সদ্য পোড়া। বেশ গভীর। কালো পোড়া রক্ত লেগে আছে এখনো।
কি ব্যাপার, পোড়া দাগ কিসের?
গরম সুই দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে পীর সাহেব!!
মানে?
স্যার আমি বলছি বলেই, মেয়ের মা বলতে লাগলেন, গেলো বছর তিনেক থেকেই রহস্যময় এক রোগে পেয়েছে মেয়েটিকে। একটু কিছু উনিশ বিশ হলেই মেয়েটি আমার অজ্ঞান হয়ে যায়। শ্বাস কস্ট হয়। দম আটকেউ যায়। খিচুনি হতে থাকে অনবরত। বুকে বান লাগে যায়। বিড় বিড় করতে থাকে। এনিয়ে কবছর থেকেই বার বার হাসপাতালে ভর্তি হই। প্রতিবার স্যালাইন ইঞ্জেকশন আর অক্সিজেন দেয়া হয়। ভালো হয়ে যায়।
আবার কদিন যেতে না যেতে সেই আগের মতো। আজ সকালে ও তাই হয়েছে। বিরক্ত হয়ে আর হাসপাতালে যাইনি। গিয়েছিলাম এক পীরের কাছে।
শুনলাম আমাদের পাশের গ্রামে এক পীর আছে তিনি নাকি "উপরী" তাড়ান। আমরা তার কাছেই গিয়েছিলাম। দুটা সাদা কবুতর, দুটো কালো মুরগী, একটি কাক, এক কেজি পোলাউ এর চাল আর এক দানা মশুরির ডাল নিয়ে।
আজব, এত্তো জিনিষ নিয়ে?
জ্বী এগুলো পীরের হাদিয়া। 
তা বুঝলাম, কিন্তু কপালে পোড়া দাগ কিসের?
জ্বি স্যার বলছি, পীর সাহেব একটা সুই দিলেন। পানি পড়া দিলেন। আর তার মুখের লালা পড়া দিলেন। 
লালা পড়া?
"হ্যা। লালা পড়া। উপরি বান কাটার মন্ত্র পড়ে তার মুখের লালা মেয়েটির সারা গায়ে মেখে দিলেন....! তার পর বললেন, যাহ বাড়ি যা...। উপরি আর লাগবেনা, লালা পড়া দিলাম তুকে। আমি আবার সবাইকে লালা পড়া দেইনা। তোর গায়ে সন্ধ্যা বেলার ত্রীমুখি রাস্তার "উপরি" লাগছিলো। তাই লালা পড়া দিলাম। উপরি এখন ভাগছে আর আসবেনা। যাহ বাড়ি যা...। কিন্তু খবর দার ভর দুপুর, সন্ধ্যা আর আমাবস্যায় এই যোয়ান মেয়ে ডা যেনো আর ত্রীমুখিতে রাস্তায় না যায়। যাইলে কিন্তু বড় ক্ষতি হইয়া যাইবো। আবার উপরি লাগবো। পুরুষ উপরি লাগবো এবার । উপরি'র মধ্যে কিন্ত দুই জাত আছে। মেয়ে উপরি আর পুরুষ উপরি। ত্রীমুখি রাস্তার উপরি গুলা আবার কঠিন "উপরি"। সেইটা তাড়াতে খুব কস্ট। বুঝছস। লাগলে খবর আছে। সারা রাইত মন্ত্র পড়তে অইবো আর লালা পড়া দিতে অইবো....", এক নিশ্বাসে মেয়েটির মা পিরের বলা কথা গুলো বললেন। তার বলার ভংগীতে বুঝলাম তিনি উপরিতে খুব বিশ্বাস করেন।
আচ্ছা তার পর...?
তারপর পিরের কাছ থেকে এক হাজার টাকা হাদিয়ে দিয়া একটা সুই নিয়া বাসায় আসি। কিন্তু বাসায় আসার পর মেয়েটি আবার অজ্ঞান হয়। তখন মনে পড়ে, পীর কইছিলো
"বড় উপরি পলাইয়া গেছেগা তয় তার ছাওয়াল পাওয়াল গুলা একটু আধটু লাইগা থাকতে পারে। একটু ডিস্টার্ব করবো। যাইবো গা কদিন পর। আর বেশি ডিস্টার্ব করলে তোরা এই সুই ডারে গরম কইরা টকটকে লাল কইরা তারপর দিবি কপালের চামড়ায় য়িতর ঢুকিয়ে.."। তাই বাড়িতে ফিরে যাবার পর মেয়েটি আবার অজ্ঞান হলে পিরের কথা মতো আমরা ওকে বেঁধে নেই এবং কপালে সুই পোড়া দেই। এই দাগটা স্যার সেই সুই দিয়ে পোড়ার ..!!!
মেয়েটি এবার ক্ষেপে গিয়ে মুখ খুললো, স্যার দেখছেন, দেখছেন পাগল দের কান্ড। আমারে কি করছে। আমার কপাল টা পোড়ায়া দিছে। আমার নাকি উপরি লাগছে। আমাকে বেঁধে গরম সুই দিয়ে আমার কপাল ঝলসে দিসে। স্যার এটা করছে দুলাভাই আর মা।স্যার দেখেন দেখেন বলে মেয়েটি তার দগদগে পোড়া দাগটি আবার দেখালো।
সত্যি, বিভৎস। কচি সাদা কপাল একেবারে পুড়িয়ে দিয়েছে উপরি তাড়ানোর আশায়। 
মা ধমক দেয় মেয়ে কে, এই বেয়াদব, চুপ চুপ। চিৎকার করবানা।
আমি বললাম, একটু থামুন। ওকে বলতে দিন...।
তারপর বলো মা, কি হয়েছে। আমি বললাম।
সে আবার বলতে শুরু করলো, 
স্যার এরা উপরি বিশ্বাস করে। আর ঐ যে পীর, ঐটা তো হারামী। পীর না। একটা শয়তান। সারা শরিরে দুর্ঘন্ধ আর ময়লা। লম্বা লম্বা নোখ। এই শয়তান আমার সারা গায়ে লালা দিছে, অয়াক থুহ.....।
মা এবার মেয়েটির মুখ চেপে ধরে। খবরদার তুমি পির কে গালি দিচ্ছো কেনো? গুনাহ হবে! মেয়েটি কে থামায় সে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা কই?
স্যার বাবা বিদেশে। বাবা থাকলে কি এই পাগল গুলা আমাকে এইটা করতো।
তোমার চাচা মামা কেউ?
"জ্বী স্যার, সবাই আছেন। কিন্তু ব্যস্ত...", মা উত্তর দিলো।
পীরের সন্ধান কিভাবে পেলেন আপনারা?
স্যার আমার বড় মেয়ের জামাই পিরের মুরীদ। সেই সন্ধান দেয়, "সুই পোড়া পীরের"। তিনি উপরি তাড়ান গতো বিশ বছর।
তা আমার কাছে এখন, কেনো? 
স্যার সুই পোড়ায় তার কপাল থেকে রক্ত বের হতে থাকে, কালো রক্ত। রক্ত পড়া বন্ধ না হওয়াতে হাসপাতালে যাই। ঐখানের বড় ডাক্তার আমাদের খুব গালি গালাজ করে। বলে তোমাদের পুলিশে দেয়া উচিৎ। পরে বলেন "ব্রেইন মানসিক ডাক্তার" এর কাছে জলদি যান। নইলে মেয়েটিকে মেরে ফেলবেন তো এই সব ছাইপাস পীর ফকির দিয়ে। তাই আসা...
ছোট্ট মেয়েটি আর কোন কথা বলছিলো না। তার গাল বেয়ে অস্রু পড়ছিলো। টোট টা কাঁপছিল। বুঝা যাচ্ছে সে কস্ট পেয়েছে, খুব কস্ট। অপমানিত ও হয়েছে খুব। কান্না লুকানোর চেস্টা করছে।
তুমি কি অজ্ঞান হয়ে যাও মা? আমি বললাম।
জ্বি স্যার, সে মাথা নাড়ে।
অজ্ঞান হবার আগে তুমি কি বুঝতে পারো যে,তুমি অজ্ঞান হতে যাচ্ছো?
না স্যার, বুঝি না।
আমরা বুঝি স্যার, মা বললেন।
আপনি কিভাবে বুঝেন? মাকে বললাম।
এইতো স্যার, কোন ব্যাপার নিয়ে ধমকালে, শাসন করলেই তার খিচুনি শুরু হয়, লম্বা লম্বা করে দম নিতে থাকে, পরে আবার দম বন্ধ হয়ে যায়। কখনো কখনো হাত পা ছুড়তে ছুড়তে অজ্ঞান হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়।
ওহ তাই....?
আচ্ছা অজ্ঞান হবার পর তুমি কিছু বুঝ মা? এই যেমন আশে পাশে কি হচ্ছে, কি করছে?
জ্বি স্যার বুঝি?
"শোন,আমার মনে হচ্ছে তোমার সমস্যা অন্য কিছুতে । তোমার মানসিক সমস্যা হচ্ছে। তোমার মনে কোন কস্ট বা ব্যাথা আছে যা তুমি সহ্য করতে পারছোনা, আবার বলতেও পারছো না", আমি সরাসরি ই বললাম।
তুমি কিসে পড়ো?
স্যার সেভেনে?
পড়াশুনা ভালো লাগে?
জ্বী?
শিক্ষক দের কেউ কি আছেন খুব শাসন করেন?
না স্যার।
ভাই, বোন কেউ আছেন অত্যাধিক শাসন করেন বা আদর?
না। সে মাথা নেড়ে বলে।
আমি মেয়েটির মাকে বললাম, "আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই একাকী.."।
মা বললেন, স্যার আমি জানি আপনি কি বলবেন। আমি থাকি, অসুবিধা নাই।
না। আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন।
"যাওনা মা, তুমি বাইরে যাও.."। মেয়ে একটু শক্ত করেই তার মাকে বললো।
আমি চেম্বার এসিস্ট সিস্টার কে একটু দূরে বসতে বললাম, যাতে মেয়েটি মন খুলে বলতে পারে।
বলো, কি সমস্যা তোমার?
স্যার কোন সমস্যা নাইতো। মেয়েটি একটু হাসলো।
তার হাসি ইন্ডিকেট করছিলো কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে তার মনে।
নাম কি তোমার?
পপি।
পপি তুমি কাউকে ভালোবাসো?
সে উত্তর দেয়না।
অনেক সময় নিরুত্তর ই উত্তর বহন করে।
কাকে ? আমি সরাসরি বললাম।
ন্যা স্যার অসব কিছুনা।
অফকোর্স। লুকিয়ো না। আমি সাইকিয়াট্রিস্ট। তোমার মতো ৮/১০টা পেশেন্ট প্রতিদিন আমাদের দেখতে হয়। বলো। আমি সাহায্য করবো তোমাকে।।
মেয়েটি একটু চুপ থেকে বললো,
হ্যা ভালোবাসি।
কাকে?
একজন কে।
কে সে?
দুঃসম্পর্কিত আত্মীয়।
কতদিন থেকে?
তিন বছর যাবৎ
এতো অল্প বয়সে ভালবাসা বাসি। কি বলো? সত্যি?
স্যার কাউকে বলবেন নাতো?
না । বলবোনা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
জ্বি স্যার আমি একজন কে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া আমি বাঁচবনা।
তাই?
জ্বী
কিন্তু তোমার যে বয়স, তাও আবার বলছো তিন বছর যাবৎ।
এতো অল্পো বয়সে তোমরা!! কি করে ছেলেটা?
ছেলেনা। উনার বয়স আছে। বাজারে উনার মোবাইলের দোকান আছে।
কিভাবে পরিচয়?
উনার দোকানের মোবাইলে আব্বু টাকা পাঠান নিয়মিত। উনি দিয়ে যান। তাছাড়া উনি আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো। সবসময় আমাদের বাসায় আসেন, থাকেন ও। খুব ভালো মানুষ। আমাদের বাজার সদাই সব উনি করে দেন।
তোমার মা এটা জানেন?
না।
লোকটির বয়স কতো?
এই তিরিশ, বত্রিশ।
কিন্তু তোমার তো বয়স খুবই কম। এতো সম্ভব না। তোমার পড়াশুনা বাকি। তোমার একটা ভবিষ্যৎ ও আছে।
জ্বি স্যার। এগুলো ভাবলেই আমার মাথা ঝিন ঝিন করে। আমি যে কি করবো!
তুমি এই কথা গুলো কাউকে বলেছো?
না স্যার। মাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু লজ্জায় বলিনি। এই প্রথম আপনাকে বললাম। বলেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
লজ্জার কিছু নেই। তোমার বয়স কম। অল্প বয়সে টুক টাক ভুল সবাই করে। এমন মারাত্মক কিছুনা। নিজের ভুল বুঝতে পারাই ঠিক। ভালোবাসা টা ভুল না। কিন্তু এটা তোমার সময় না। তোমার এখন পড়ালেখার সময়।
জ্বী স্যার। 
শোন তুমি তোমার মাকে খুলে বলো সব। হাজার হোক তোমার মা। তিনি হয়তো একটু রাগ করবেন। কিন্তু তোমাকে এই মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবেন তিনি। আমি কি তোমার মাকে একটু ঈংগিত দিবো?
না স্যার। আপনি যখন বলছেন, আমি মাকে সব বলবো। আসলে আমি অনেকদিন থেকে বলতে চাচ্ছি।কিন্তু লজ্জা আর ভয়ে বলছিনা।
আচ্ছা স্যার সবাই আমার বলে মৃগী রোগ হয়েছে। উপরি ও বলে। আসলে কি তাই?
না।ওগুলো কিছুনা।
তাহলে আমার কেনো এমন হয় হটাৎ মাঝে মধ্যে?
তোমার রোগ টির নাম কনভার্সন ডিসঅর্ডার। এই যে তোমার মনের মধ্যে একটি দন্দ , অসম ভালোবাসা যা থেকে বেরুতে পারছোনা এটাই তোমার সমস্যার কারন। এটা তুমি কাউকে বলতে পারছো না, আবার এর থেকে বেরুতেও পারছোনা। ভালো মন্দ, নিশ্চিত অনিশ্চিত এর সাথে সারাক্ষণ তোমার মন ঝগড়া করছে। আর তোমার মনের এই সমস্যা টা যখন প্রকট হয় তখন তার লক্ষন দৈহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। এটাই "কনভার্সন ডিসওর্ডার"।যতক্ষণ যতদিন তোমার সমস্যা তুমি কাউকে শেয়ার করছোনা, কাউকে বলছোনা ততক্ষণ ততদিন তুমি সুস্থ হবেনা।
স্যার আপনি বলেন আপনি বুঝলেন কিভাবে?
হা হা, আরে পিচ্চি মেয়েটা কি বলে। এটাই তো আমার সাবজেক্ট।
আমি কি ভালো হবো?
অবশ্যই। তুমি তোমার সমস্যা টা খুলে বলতে পেরেছো, কিংবা আমি তোমার মনের ভিতর থেকে বের করে এনেছি, যেটাই বলো, এটাই হলো এই রোগ এর চিকিৎসা। জাস্ট শেয়ার করা। বাদ বাকি তোমার মনোবল। তুমি পড়াশুনা করো। মনে হচ্ছে তুমি ব্রিলিয়ান্ট। তোমার ক্লাসে রোল কত?
স্যার দুই। তবে সব সময় এক ছিলো। আমার এই রোগ উঠে যায় বলে এখন পড়তে পারিনা আগের মতো।
অসুবিধা নেই আর রোগ আর উঠবেনা। যাও তোমার মাকে আসতে বলো।
স্যার আরেকটি কথা...
কি?
স্যার আমার কপালের পোড়া সেরে যাবে, দাগ মুছবে?
হ্যা, ঘা সেরে যাবে। কিন্ত দাগ কিছু টা থেকে যাবে। সব দাগ মুছে যায় না।
স্যার উনার ছবি দেখবেন?
কার?
ঐ যে উনার, মোবাইলে আছে!
নাহ।
ঠিক আছে তবে সব মুছে দেই?
হ্যা। গুড তাই করো...।
মেয়েটি আমার সামনেই মেমোরি কার্ড বের করে ভেংগে ফেললো......!

ডা. সাঈদ এনাম
ডা. সাঈদ এনাম
এমবিবিএস (ডিএমসি)
এম ফিল (সাইকিয়াট্রি)
সাইকিয়াট্রিস্ট এন্ড নিউরোলজিস্ট
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সিলেট।

Post a Comment

Previous Post Next Post