ডা. সাঈদ এনাম: সিলেট কাজির বাজারে নতুন যে ব্রীজ টি হয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। সন্ধ্যে বেলা নিয়ন আলো ঝলকানি ব্রীজ ছাড়িয়ে নদীর উপর গিয়ে পড়ে। নদীর শান্ত জ্বলে নিয়ন আলোর খেলা, ঝিরি ঝিরি বাতাস এক কথায় অপূর্ব। হয়তো এজন্যই বিকাল হতেনা হতে ছেলে মেয়েরা দল বেধে আসে, বসে গল্প করে, ফুচকা খায়। ওখানে দু'তিনটা মোবাইল ফুচকা দোকান আছে। তাদের নিজস্ব বসার ব্যবস্থা ও আছে। অনেকে ফুচকা খায়, আবার সেল্ফি তোলে। এক বার দুই বার তিনবার.....। সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে আপলোড করে ফেইস বুকে। স্ট্যাটাস দেয়,
"সেল্ফি ব্রীজে ফুচকা খাই....."।
সিলেট শহরের এই ব্রীজটি কে বলা হয় "সেল্ফি ব্রীজ"।
সিলেট সিভিল সার্জন অফিসে মিটিং থাকলে আসতে যেতে আমি এই ব্রীজ ই ব্যবহার করি। ভালো লাগে। গাড়ী নিয়ে হাই স্পিডে ব্রীজের উপর উঠলে মনে হয় ব্রীজ নয়, যেন ফ্যান্টাসি কিংডমের কোন এক রাইড। বেশি মনে হয় রেল গেট থেকে ব্রীজের উপরে উঠার পর যে বাক টি নিয়েছে ওই জায়গাটা। বিশাল এক বাঁক।
সেদিন ভর দুপুরে কি কাজে যেন যাচ্চিলাম ঐ দিকে। রিক্সা দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম এক লোক উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। এতো রোদের মধ্যেও সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভাবলাম ভাসমান গাঁজাখোর হবে। রাতে পেট ভরে গাজাখেয়ে এই শান্ত নিরিবিলি জায়গাটাকে বেছে নিয়েছিলো ঘুমানোর, কিন্তু এতো গভীর ঘুম কখন যে সকাল দুপুর হয়ে গেছে টেরই পায়নি । কি মনে করে আমি রিক্সা ড্রাইভার কে বললাম ঐ লোকটার কাছে যাও। সে গেলো। আমার বলার আগেই সে কাছে গিয়ে টুং টাং করে রিক্সার বেল বাজিয়ে উঠিয়ে দিলো।
হাই তুলে বললো সে
হাই তুলে বললো সে
কি ব্যাপার, ঠেলা লাগবো?
না
তাইলে ঘুম ভাংলা কেন মিয়া । কি মজার ঘুম ঘুমাইছিলাম রে।
না
তাইলে ঘুম ভাংলা কেন মিয়া । কি মজার ঘুম ঘুমাইছিলাম রে।
স্যারে কইসে, রিক্সাওয়ালা আমার দিকে দেখিয়ে দিলো।
স্যারে কইসে?! সে আমার দিকে তাকায়। ময়লা জামা কাপড় হাত দিয়ে একটু ঠিক ঠাক হয়ে বলে
স্যার আপনি কি পুলিশ নিহি?
না
তাইলে ক্যা আপনে
স্যারে কইসে?! সে আমার দিকে তাকায়। ময়লা জামা কাপড় হাত দিয়ে একটু ঠিক ঠাক হয়ে বলে
স্যার আপনি কি পুলিশ নিহি?
না
তাইলে ক্যা আপনে
আমি ডাক্তার। সাইকিয়াট্রিস্ট। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভর দুপুরে তোমার ঘুম দেখে ভাবলাম জাগিয়ে কথা বলি। কিভাবে এই তীব্র রোদে এমন গভীর ভাবে ঘুমাও।
হি হি স্যার আসলে খুব পরিশ্রম হয়েছে কাল। রিক্সা ঠেলতে ঠেলতে গা ব্যাথা। দুটা ডাল ভাত খেয়ে দিলাম ঘুম। এমন ঘুম। মরা মাইনষের লাহান। এতো বেলা এতো রোদ, টেরই পাইলামনা...। একটু লাজুক ভংগিতে বললো।
তোমার নাম কি?
বশির
বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনা
এখানে কি রিক্সা ঠেলো?
জ্বি স্যার। এখানে ঠেলাই, ওই ব্রীজেও ঠেলাই। হাত দিয়ে পুরাতন কীন ব্রীজটার দিকে ইংগিত করে। চারদিন ঐটা তে, দুই দিন এইটাতে। শুক্কুর বার ঠেলাই না। একটা রিক্সা ভাড়া কইরা বউডারে লইয়া ঘুরাই..।
বশির
বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনা
এখানে কি রিক্সা ঠেলো?
জ্বি স্যার। এখানে ঠেলাই, ওই ব্রীজেও ঠেলাই। হাত দিয়ে পুরাতন কীন ব্রীজটার দিকে ইংগিত করে। চারদিন ঐটা তে, দুই দিন এইটাতে। শুক্কুর বার ঠেলাই না। একটা রিক্সা ভাড়া কইরা বউডারে লইয়া ঘুরাই..।
বউও আছে। তবে যে এখানে ঘুমালা। বউ কিছু কবে না?
হি হি.... না স্যার কবে না। হ্যাতো এহন এখানে নাইতো। বায়িত গেছে। পোয়াতি। বউ ছাড়া একলা ঘরে হুইতে মন চায় না। সারা রাত আকু পাকু করে মন হেথের লাইগা। তাইনা এইখানে আইসা মাঝেমধ্যে ঘুমাই। অবশ্য ঘুমানোর পেথ্যম আগে কয়েকটা তারা গুনি। খোলা আসমানের ২০/২৫ টা তারা গুনার পর আর কিছু কইতে পারিনা। যাউগ্যা স্যার, আপনের লাইগা কি করুম কন।ক্যান আইছেন...?
আমার বশিরের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো। ইনফ্যাক্ট আমি যা চাচ্ছিলাম সেটা পেলাম, এই জন্য। আমার জানার আগ্রহ ছিলো ভর দুপুরে তীব্র রোদের মধ্যে তার এই অনাবিল শান্তির গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়ার কারন। সুখী মানুষের ঘুম। কিন্তু সে কোথায় কিভাবে এতো সুখ পেলো। তার ঘুম দেখে মনে হচ্ছিলো এই মুহুর্তে সিলেটের সবচেয়ে সুখী মানুষ সে। আসলেই সে একজন সুখী মানুষ। ঘর নাই, বাড়ি নাই, ব্যাংক ব্যালেন্স নাই তার পরও সে সুখী। সুখী মানুষ রা মরার মতো ঘুমায়। মরার মতো ঘুমে কি সুখ, এটা যারা ঘুমায় তারা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেনা।
ক'দিন আগে চেম্বারে এক ভদ্র লোক আসলেন। সাত দিন হতে চললো তিনি এক ফোটা ঘুমাতে পারছেন না। না ঘুমাতে না ঘুমাতে তিনি কেমন হয়ে যাচ্ছেন। তার কিছুই ভাল্লাগেনা। মেজাজ চড়া হয়ে গেছে। কাজ কর্মে মন দিতে পারছেন না। সব কিছুতেই ভুল হচ্ছে বার বার। তার পুরো হিস্ট্রি টা নিলাম আমি। শহরের যে কয়েকজন পয়সাওয়ালা লোক তিনি অন্যতম । ব্যবসা বাণিজ্য কোন কিছুরই কমতি নেই। স্ত্রী, সন্তান সবই আছে। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্টুর পরিহাস তিনি ঘুমাতে পারছেন না সাত দিন যাবৎ। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। কেন ঘুম হয় না। কি তার অপরাধ, বলতে বলতে একেবারে কেঁদেই ফেললেন। না ঘুমানোর যে কি যন্ত্রনা এটা তিনি বুঝাতে পারছেন না কাউকে।
স্যার আমাকে কিছু দেন আমি খেয়ে মরে যাই। আমি আর পারছিনা.....।
মানুষের ঘুম না হবার একটি কারন হলো স্ট্রেস। প্রচণ্ড স্ট্রেস তার স্লিপ সেন্টার কে তছনছ করে দেয়। যারা মানসিক রোগী তারা ঘুমাতে পারেনা। চোখ বন্ধ বা খোলা রেখে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটিয়ে দেন। তাদের ব্রেইনের নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন সেরোটোনিন ব্যালেন্স সিস্টেম পুরোটাই ওলট পালট হয়ে যায়। তাদের ইনসাইট লস হয়ে যায়। আমি খানিকটা সময় নিয়ে কথা বললাম তার সাথে। সামান্য একটা ঘুমের ঔষধ দিলাম। একটা পরামর্শ দিলাম।
কিন্তু পরামর্শ যেটা দিলাম সেটা শুনে তিনি বললেন অসম্ভব। এটি তিনি মানতে পারছেন না আপাতত। ব্যবসা বানিজ্যের পিক সিসন। আমি বললাম তাহলে ঔষুধে কাজ হবেনা। আপনাকে কিছুদিন সব কিছু ছেড়ে থাকতেই হবে। সবুজের সাথে বসবাস করে বুক ভরে সতেজ নিশ্বাস নিতে হবে। তিনি বললেন এসব নাকি করেছেন কি এক সেন্টারে গিয়ে। কাজের কাজ কিছু হয় নি। গুনে গুনে সেশন এর নাম করে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে তারা। শেষতক ঐ রিলাক্সেশন সেন্টারের ম্যানেজারের কলার ধরে টানাটানি করে এসেছেন।
যাহোক আমি তাকে একটু বুঝিয়ে বললাম সত্যি আপনি ক'দিন আপনার গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসুন। চার দেয়ালের ভিতর এসি রুমে বসে রিলাক্সেশন এর নামে সবুজের কল্পনা করে করে নিশ্বাস নিলেই হয়না। এসব প্রতারনা চিকিৎসা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। আর যারা এসব রিলাক্সেশন থেরাপি দেয় তাদের বেশির ভাগ ই আন্ডার মেট্রিক পাশ। অবচেতন মন ঠিকই ধরে ফেলে রিলাক্সেশন এর সেশন নামে আপনার সাথে প্রতারণা হচ্ছে।
বশির তোমার সাথে আমি একটু কথা বলবো। তুমিতো এখানেই রিক্সা ঠেলো তাইনা। আমি বিকেলে ফেরার সময় এখানে কিছুক্ষণ বসবো। তোমাকে আমার পক্ষ থেকে ফুচকা খাওয়ার
দাওয়াত। ওকে?
দাওয়াত। ওকে?
আমার সাথে কথা, ক্যান স্যার। আমি এক সাধারণ মানুষ, রিক্সা ঠেলি, খাই, আর মরার মতো ঘুমাই। মাঝেমাঝে বউরে নিয়া রিক্সায়
দিয়া ঘুরি। এখনতো বউ নাই। বাপের বাড়ি। আমার লগে কি কতা কইবেন।
দিয়া ঘুরি। এখনতো বউ নাই। বাপের বাড়ি। আমার লগে কি কতা কইবেন।
আছে। তুমি এখন কি করবা।
আমি নদীতে নাইমু। একটু সাঁতার কাটমু। তার পর আবার রিক্সা ঠেলমু। তবে তার আগে বউ এর লগে একটু কতা কমু মোবাইলে। আর কিছু টেকা বিকাশ করুম তারে আর গ্রামের বাইত্যে মায়ের কাছে।
ঠিক আছে আমি যাই। তুমি থাকবা, তোমার কিন্তু ফুচকার দাওয়াত।
........
বশিরের সাথে কথা বাড়াতে পারলামনা। ওসমানী মেডিকেল কলেজে সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট এর আয়োজনে একটি বিশেষ সেমিনার ছিলো। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে নামকরা সকল সাইকিয়াট্রিস্ট রা এসেছেন। ডা. মতিন এম ডি স্টুডেন্ট এমন ভাবে ধরলো যে, না গেলে নিজের কাছে ও খারাপ লাগবে। সেমিনারে সেখানে অনেক পুরাতন কোর্সমেট বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। অন্যান্য ডেসিপ্লিনের ও বিশেষজ্ঞ রা ও উপস্থিত ছিলেন। গেটে দেখা হয় ডা শোয়েব ভাইয়ের সাথে, সে সদ্য এম ডি করেছে কার্ডিওলজীতে। কাছে এসে একটু হেসে বললেন বংশের বাত্তির কি খবর। কবে আসবে? আসছেতো? আমি বললাম আপনিও তাইলে খবর রাখেন দেখছি। আরে রাখবোনা, কি যে বলেন।
সেমিনার রুমে ঢুকে বসতে যাচ্ছি ডা. তবিব ভাই দেখি অধ্যাপক সারিতে বসা। তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলেন তার পাশের সিটে বসার। ডা. তবিব ভাই আমদের এক্স ঢাকা মেডিকেলের। আমার প্রায় ৮ বছর আগের ব্যাচের। স্কীন এ এম ডি করেছেন বাংলাদেশের হাতে গোনা ক'জনের একজন। দারুন মেধাবী।
আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন এ থিসিস লেখার সময় ডাটা এনালাইসিস করতে উনার পরামর্শ নিয়ে ছিলাম। থিসিসের টপিক ছিলো ব্রেইন স্ট্রোক। অর্থাৎ ব্রেইন স্ট্রোক করার পর একজন রোগীরর কি কি মানসিক সমস্যা হয়। আমার স্টাডিতে বেরিয়ে আসে প্রতি একশো জনে কমপক্ষে প্রায় ২৪ জন স্ট্রোক রোগী মারাত্মক ভাবে ডিপ্রেশন এ ভোগেন।
স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাপানী, ব্লাড প্রেশার এসব দীর্ঘ মেয়াদী রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগী রা এক পর্যায়ে তাদের ডিপ্রেশন ভুগে এতে এ রোগ গুলোর পরিধি বাড়ে কমপ্লিকেশন ত্বরান্বিত হয়। আমার টপিক সিলেকশন দেখে তবিব ভাই বললেন থিসিসে সবাই একটু ইজি টপিক সিলেক্ট করে। তুমি এতো কঠিন একটা কেনো নিলে। আমি বললাম, তবিব ভাই আগে বুঝিনি এতো কঠিন হবে।
আসলে নিউরোমেডিসিন এ প্লেস মেন্টের সময় হঠাৎ একদিন অধ্যাপক মতিউর রহমান স্যার কে বললাম, স্যার "ব্রেইন স্ট্রোক" নিয়ে থিসিস করতে চাচ্ছি। স্যার অত্যন্ত একাডেমীক। ডি এম সি'র স্টুডেন্ট। খুব অল্প বয়সে এফ সি পি এস করেন। বর্তমান বাংলাদেশের বিখ্যাত নিউরোমেডিসিন স্পেশালিষ্টদির একজন। তিনি কি চিন্তা করে বললেন বললেন "হ্যা ভালোতো । এই বিষয়ে কাজ হয়েছে কম। করতে পারলে ভালো হবে"।
ব্যাস,স্যারের মুখে ভালো হয় শুনে আর ডান বাম তাকাইনি। টপিক সিলেকশন ফাইনাল হয়ে যায়। স্যার ই টাইটেল টা ঠিক করে দেন। তিনি ছিলেন আমার থিসিসের কো গাইড। আর অধ্যাপক গোপাল স্যার ছিলেন গাইড। কয়েক মাস দিন রাত নেট ঘেটে, বই পড়ে থিসিস টা রেডি করিয়ে কয়েকবার স্যার কে দেখাই, কারেকশন নেই।
ফাইনাল রেডি করে যখন স্যার কে দেখাবো সে সময় স্যার রিকাবী বাজারের কাচা বাজারটি সংলগ্ন মসজিদের সামনে ছোট একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে পায়ে আঘাত পান। স্যার আসরের নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন এমন সময় হঠাৎ একটা হোন্ডা এসে পায়ের উপর পড়ে। স্যার হাঠুতে চোট পান।
আমি স্যারের বাসায় গিয়ে থিসিসের ফাইনাল কপি টা নিয়ে যাই। স্যার বিছানায় আধা শোয়া। পায়ে লম্বা প্লাস্টার। পাশে দির্ঘক্ষন বসি। স্যার আরো কিছু কারেকশন দিয়ে বলেন "ভালই হয়েছে জমা দিয়ে দিতে পারেন"। স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে সোজা মেডিকেলের সামনে পি সি বাজার ফটোকপি দোকানে আসি। কারেকশন করে যাই কুদরত উল্লাহ মার্কেটের পিছনে থিসিস বই ফাইনাল বাধাই করতে।
সিলেট মেডিকেলের সকল পোস্ট গ্রাজুয়েশন স্টুডেন্ট দের কাছে হোস্টেল আর এই দুই জায়গা বেশ পরিচিত। পোস্ট গ্রাজুয়েশন হোস্টেলে সিনিয়র দের মধ্যে ছিলেন ডা আজাদ ভাই। উনার বিখ্যাত এ-৬ রুমে প্রতি সন্ধায় পড়তে আসতো এম ডি কার্ডিওলজির স্টুডেন্ট ডা. ইকবাল। সে আর এফ সি পি এস মেডিসিন লাস্ট পার্ট এর স্টুডেন্ট ডা. আজাদ ভাই ছিলেন পরস্পর রিডিং পার্টনার। আজাদ ভাই ছিলেন পোস্টগ্রাজুয়েট হোস্টেলে আমাদের সবার বড়। আমরা তাকে ডাকতাম ব্রিগেডিয়ার আজাদ ভাই। আরেক সিনিয়র এম ডি পেডিয়াট্রিক্স এর স্টুডেন্ট ডা ফারুক ভাই থাকতেন এ-১ রুমে। চড়া গলায় উচ্চস্বরে কথা বলতেন বলে উনাকে আমরা ডাকতাম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারুক ভাই। একদিন বিকালে সেখানে পড়তে আসা ডা ইকবাল তার পায়ের সু'টার দিকে ইংগিত করে বলে "ভাই ডিজার্টেশনের কারেকশন নিয়ে, পি সি বাজার টু কুদরত উল্লা লেফট রাইট করতে করতে দ্যাখেন জুতার অবস্থা। একেবারে তেনা তেনা। নতুন যে কিনবো সে সময়ও নাই টাকাও নাই"। ইকবাল আর আমি একসময় ঢাকায় মেডিকেলের ভর্তির কোচিং করতাম।
আসলে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের একেবারে শেষ দিকে সব ডাক্তার ছাত্রদের ই একই অবস্থা হয়। মারাত্মক হাত খরচের টান পড়ে, সাথে সময়ের ও। কারন প্রচুর পড়ার চাপে থাকায় ঐ সময় টুকটাক চেম্বার ও করা যায়না, পরিবারে সময় ও দেয়া যায়না। পড়তে পড়তে রাত হয় ভোর, ভোর হয় বিকাল।
যাহোক সেমিনার রুমে ডা. তবিব ভাই এর পাশে বসলে তিনি ফিস ফিস করে বললেন "ভালই'তো লিখো। চুপচাপ সাইকোলজি গিলাচ্ছো আমাদের, তা তোমার বংশের বাত্তির কি হলো শেষমেশ"। আমি হেসে বললাম ভাই এখনো শেষ হয়নি। অপেক্ষা করেন বাতি তো জ্বলতেও পারে।
সেমিনার শেষে গেলাম জিন্দাবাজারের বইয়ের দোকানে। সাইকিয়াট্রির দুটো বই এর ওর্ডার করেছিলাম। তারা ঢাকা থেকে আনিয়ে দিবে । কিন্তু পাচ্ছেনা।
একবার ঢাকা যেতে হবে। কিন্তু ঢাকাতে খুব ট্রাফিক জ্যাম। এই ভয়ে যাওয়া হয়না। ঢাকায় বসবাস কারীদের কাছে তাদের এই জ্যাম গা শোয়া হয়ে গেছে। প্রতিদিন অফিসে আসতে ও যেতে চার ঘন্টা অলস বসে থাকা তাদের নিত্যদিনের সংগী। মানুষ গুলোও যেমন কেমন।চুপচাপ বসে থাকে জ্যামে। কেউ পান খায় একটার পর একটা, কেউ পত্রিকা পড়ে, কেউ মোবাইলে গেম খেলে, কেউবা আবার পড়াশুনা করে। আসতে ও যেতে দু থেকে তিনটা ঘন্টা তাদের চলে এরকম। অথচ হেটে গেলে লোকগুলো এক ঘন্টা অনায়েসে যেতে পারতো। কিন্তু হাটবেনা।
ঢাকার গার্মেন্টস কর্মী রা কিন্তু হেটে যায়। দল বেধে রাস্তার দু'ধার ধরে হেটে তারা অফিসে যায়। হাতে থাকে ছোট একটা পুটলি। এতে থাকে দুপুরের ভাত, তরকারি। যে যা পারে তাই নেয়। কারন ফিরতে হয় সেই সন্ধ্যায়। ভোর সকালে বা সন্ধ্যার সময় আশুলিয়ার দিকে কেউ গেলে এ দৃশ্য টি দেখবেন। তারা হেঠে যায় কারন তাদের বাসে যাওয়া আসা ভাড়ায় কুলোয় না। কতই বা বেতন পায়। আর হাঠে বলেই তাদের রোগ বালাই হয় কম। সব রোগ ভর করে ঐ জ্যামে অলস বসে থাকা লোকদের।
মাঝে মাঝে ভাবি জ্যামের এই সময়টা কি ভাবে কাজে লাগানো যায়। কয়েকটা সেলাই মেশিন বাসে ফিট করে দিলে ভালো হতো। সবাই বাসে বসে বসে সেলাই করতো। বাস চলছে ভট ভট ভিতরে সেলাই মেশিন চলছে ঘট ঘট। বাস মালিকরা যাত্রিদের জ্যামের সময় কে এভাবে কাজে লাগাতে পারে। বিনিময়ে ভাড়া ফ্রি হবে। কারাগারে যেভাবে বন্দী কয়েদী দের কাজে লাগানো হয়। "কারা হস্তশিল্প"।
হা হা মন্দ না। ঢাকার ফুটপাতে বিক্রি হতে দেখা যাবে "ট্রাফিক জ্যাম হস্তশিল্প"।
হা হা মন্দ না। ঢাকার ফুটপাতে বিক্রি হতে দেখা যাবে "ট্রাফিক জ্যাম হস্তশিল্প"।
ঢাকার নীল ক্ষেত মার্কেটে সকল ধরনের বই পাওয়া যায়। বই খুঁজতে খুঁজতে যখন ক্লান্ত, ব্যার্থ হয়ে ফিরছেন ঠিক তখনই দেখবেন ওখানের পুরোতন দুটো বটতলার একটিতে আপনার বইটি পড়ে আছে। বটতলার বইগুলো এন্টিক, দামেও কম। বেশ কবছর আগে একবার ম্যাকয়েভেলীর "দা প্রিন্স" বইটি কিনতে গিয়েছিলাম নীলিক্ষেত। অনেক খুজে পাইনি। পরে দেখি বটতলায় পড়ে আছে বইটি। একটু পুরাতন। ওটাই নিলাম। বিশ টাকা দিয়ে।
বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি বই, দাম কুল্লে বিশ টাকা। বইটি আমি কম হলেও পনেরো বার
পড়েছি। প্রতিটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। এখনো আছে সংগ্রহে। যদিও গল্পের বই পড়ার অভ্যেস আমার কম। পড়ার মধ্যে কেবল রবীন্দ্রনাথ এর ছোট গল্পের বইটা বেশ কয়েকবার পড়েছি। আর পড়েছি আল মাহমুদের কিছু বই। অসাধারণ।
পড়েছি। প্রতিটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। এখনো আছে সংগ্রহে। যদিও গল্পের বই পড়ার অভ্যেস আমার কম। পড়ার মধ্যে কেবল রবীন্দ্রনাথ এর ছোট গল্পের বইটা বেশ কয়েকবার পড়েছি। আর পড়েছি আল মাহমুদের কিছু বই। অসাধারণ।
হুমায়ুন, সুনীল, শরৎ উনাদের বই আমার তেমন একটা পড়িনি। তবে পড়া উচিৎ। উনাদের কিছু বই আছে টাইম পাসিং। দারুন সময় কাটে। অবশ্য আমার পড়া বই গুলো একটু ভিন্ন স্বাদের, রাশিয়ান কিছু রাইটারের বই আছে, বেশ ভালো। পড়বো পড়বো স্থীর করেছি, কিন্তু সময় সময় বের করতে পাচ্ছিনা।
জিন্দাবাজারের দোকানি আরো এক সপ্তাহের সময় চাইলো । যাহোক জিন্দাবাজার থেকে চলে গেলাম কাজির বাজার। বশিরের সাথে একটু আলাপ বাকি ছিলো। বশির একজন সুখি মানুষ। তার সুখের কারন জানতে হবে। মানুষ সুখ চায়। প্রয়োজনে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে হলেও সুখ কিনবে। কিন্তু সুখতো কেনা যায় না। সুখ বিনিময় করা যায়। অন্যকে সুখী করলে তার বিনিময়ে নিজে সুখী হওয়া যায়। কিন্তু মানুষ অন্যের সুখের বিনিময়ে সুখী হতে চায়না। সে কেবল নিজেই সুখী হতে চায়, যে ভাবেই হোক, ছলে বলে কৌশলে। কিন্তু তা কি আর হয়। উপরে সৃষ্টি কর্তা বলে একজন আছেন। তিনি যে চান সবাই সুখে থাকুক। অন্যের সুখ হরন করে কেউ সুখী হোক এটা তিনি চাননা।
বশিরের কাছ থেকে সুখী হবার টোকেন টা জেনে নিতে হবে। কোন হাইপোথিসিস না। একেবারে নিখাদ সত্য জিনিষ। তার কিছুই নাই অথচ সে দিব্যি সুখে দিন যাপন করছে। তার কাছ থেকে পাওয়া সুখী হবার টিপস টোকেন নিয়ে পিংকি কে আশ্বস্ত করতে হবে। কিছু না থাকলেও কিভাবে সুখে থাকতে হয় সেটা পিংকিকে বুঝাতে হবে। জীবনটা সে শুরুই করতে পারলোনা, অথচ আচমকা ঝড় এসে তার সব তছনছ করে দিচ্ছে। ওকে ঠিক মতো কাউন্সেলিং না করলে ডিপ্রেশনে সে সুইসাইড করে বসতে পারে।
কাজির বাজার যেতে যেতে সন্ধ্যে হয়। গিয়ে দেখি বশির আগে বাগেই একটা ফুচকার দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ব্রিজের নিচে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত নদীর পানিতে নিয়ন আলোর ঝলকানি দেখছে।
স্যার আসছেন। আমাকে রিক্সা থেকে নামতে দেখেই সে সালাম দেয়। বশির একটু পরিপাটি হয়ে এসছে। মাথায় তেল দিয়েছে মনে হচ্ছে জেল দিয়ে এসেছে। আসলে হেয়ার জেল নয়। ষরিসার তেল মেখেছে। ঘন চুলে ষরিষা তেল কে হেয়ার জেলের মতো লাগে। দুপুরে যখন তাকে দেখছিলাম একটু কালচে লাগছিলো। কিন্তু এখন তাকে বেশ ফর্সা ফর্সা লাগছে।
কি ব্যাপার বশির, রিক্সা ঠেলতে যাওনি বিকালে।
না সার। ফুচকার দাওয়াত আমার,আপনি আসবেন ভাবলাম আজ বিকেলে আর রিক্সা ঠেলবো না।
না সার। ফুচকার দাওয়াত আমার,আপনি আসবেন ভাবলাম আজ বিকেলে আর রিক্সা ঠেলবো না।
ওহ তুমি অপেক্ষায় ছিলে বুঝি
জ্বি স্যার। জীবনের প্রথম দাওয়াত। গরীব মানুষ বলে কেউ কোনদিন দাওয়াত করে খাওয়ানি কিছু। না এসে কি পারি।
এখানে কি করছিলে।
স্যার অপেক্ষা করছিলাম আর নদীতে নৌকা গুনছিলাম। দেখেন স্যার হলদে আলোতে কি সুন্দর লাগছে সবকিছু।
হ্যা বশির,জায়গাটা খুব সুন্দর।
আমি এই প্রথম দেখলাম স্যার। অথচ এইখানে আমি রিক্সা ঠেলি ছ'মাস। এতোদিন ও এই সুন্দর দৃশ্য দেখিনি। আজ আপনার জন্যই দেখলাম। আমার বউকে একটু আগে ফোন করছিলাম। এতো সুন্দর একটা জায়গায় আমারে কেউ ফুচকা খাওয়াবে, তার পর তিনি কিনা একজন ডাক্তার এইডা সে বিশ্বাসই করে না। ইস আইজকা যদি বউডা থাকতো কত্ত খুশী অইতো।
এখানে কি করছিলে।
স্যার অপেক্ষা করছিলাম আর নদীতে নৌকা গুনছিলাম। দেখেন স্যার হলদে আলোতে কি সুন্দর লাগছে সবকিছু।
হ্যা বশির,জায়গাটা খুব সুন্দর।
আমি এই প্রথম দেখলাম স্যার। অথচ এইখানে আমি রিক্সা ঠেলি ছ'মাস। এতোদিন ও এই সুন্দর দৃশ্য দেখিনি। আজ আপনার জন্যই দেখলাম। আমার বউকে একটু আগে ফোন করছিলাম। এতো সুন্দর একটা জায়গায় আমারে কেউ ফুচকা খাওয়াবে, তার পর তিনি কিনা একজন ডাক্তার এইডা সে বিশ্বাসই করে না। ইস আইজকা যদি বউডা থাকতো কত্ত খুশী অইতো।
আইচ্ছা স্যার কেনো ডাকছেন।
নাও ফুচকা খাও। আমি তার দিকে প্লেট টা এগিয়ে দিলাম। আমি চেয়ারে বসলাম তাকেও বসতে বললাম কিন্তু সে ফুটপাতে আরাম করে বসলো। বসার আগে ফু' দিয়ে জায়গাটা একটু পরিষ্কার করলো। একটু লাজুক হাতে সে ফুচকার প্লেট হাতে নিলো। তার চোখ ছল ছল। নিয়ন আলোয় চিক চিক করছে।
তুমি কাঁদছো
না স্যার, সে চোখ মুছছে।
না স্যার, সে চোখ মুছছে।
বশির আমি মুলত এসেছি তোমার দুঃখ জানতে। আমার মতে তুমি খুব সুখী একজন মানুষ। কিছু নেই তোমার তারপর ও তুমি সুখী । এটা কি করে সম্ভব। তাছাড়া সুখী মানুষের কোন দুঃখ আছে কি না সেটা আমার জানা দরকার। খুব দরকার। তাই তোমার সাথে কথা বলা।
হা হা স্যার কি যে বলেন।
আমরা গরিব মানুষ, আমাদের সুখ ই কি আর দুঃখ বা কি।
হা হা স্যার কি যে বলেন।
আমরা গরিব মানুষ, আমাদের সুখ ই কি আর দুঃখ বা কি।
না, হেয়ালি নয়। সত্যি করে বলো
না তেমন কিছু নাই, তয় স্যার ছোড একটা ঘটনা আছে। মাঝে মাঝে মনে অইলে কইলজা ছ্যাঁত কইরা উঠে। কিন্তু ওইটাতো আমারে তেমন দুখ দেয়না। কমু ঘটনা টা।
হু বল।
না তেমন কিছু নাই, তয় স্যার ছোড একটা ঘটনা আছে। মাঝে মাঝে মনে অইলে কইলজা ছ্যাঁত কইরা উঠে। কিন্তু ওইটাতো আমারে তেমন দুখ দেয়না। কমু ঘটনা টা।
হু বল।
আমি যখন খুব ছোড আছিলাম তখন আমার সাইকেল চালানোর খুব শখ ছিলো। বাবায় গরিব দিন মজুর। হে কেমনে আমারে সাইকেল কিনে দিবো। একবেলা খাইতেই পারিনা তা আবার সাইকেল। আমাদের ঐখানে মতি মিয়া নামে এক লোকের একটা রিক্সা, সাইকেল মেরামতের দোকান আছিলো। হেইখানে সে সাইকেল ভাড়া দিতো। চার আনা আধা ঘন্টা, আট আনায় একঘন্টা। আমি প্রায়ই ভাড়া নিতাম। স্কুল ফাকি দিয়ে আধা ঘন্টা এক ঘন্টা ভাড়া নিতাম আর গ্রাম ঘুরে ঘুরে চালাতাম।
একদিন এক খালে উল্টায়া পইড়া গিয়া আঘাত পাই সাইকেলটার পেডেল ও ভাইংগা যায়। মতি মিয়া ছেইত্যা আমারে আটকায়। বাবারে ডাইকা আনে। দুইশো টাকা না দিলে আমারে ছাড়বেনা বলে। আমার বাবা তার হাত পায়ে ধরে তাও ছাড়ে না। পরে কিস্তিতে ১৫০ টাকা দিবে এই শর্তে মতি মিয়া আমারে ছাড়ে। বাবা আমায় বাড়ি নিয়া আসে।
একমাস বাবা আমার লগে কথা কয় না। আমি কথা বলতে চাইতাম, মাফ চাইতে যাইতাম বাবা মুখ সরাইয়া নেয়। আমি মায়ের আচল ধইরা ধইরা খালি কানতাম। মাও কইতো, মাসুম ছাওয়াল হে কি বুঝে। মাফ কইরা দেন না। কিন্তু বাবা কথা কয় না।
একদিন বাবার কঠিন বেরাম হয়। মায় আমারে আর বাবারে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার ভর্তি হইতে কয়। বাবারে ভর্তি করি। বাবার ওলমি (জন্ডিস) ধরা পড়ে। মাইট্যা ওলমি।
একদিন বাবার কঠিন বেরাম হয়। মায় আমারে আর বাবারে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার ভর্তি হইতে কয়। বাবারে ভর্তি করি। বাবার ওলমি (জন্ডিস) ধরা পড়ে। মাইট্যা ওলমি।
বাবার সারা গা হলুধ অইতে থাকে। মনে হয় কে যেনো কাচা হলুধ বাবার গায়ে মাইখা দিছে। টানা দশদিন বাবা হাসপাতালে থাকে। বাবার পেট ফুইলা যায় শ্বাস নিতে কস্ট হয়। বাবার পেট থেকে পানি বের করে এক ডাক্তাররা। তার পর রক্ত দিতে কয় । আমরা রক্ত মিলাইতে পারিনা। পরে এক ডাক্তার স্যার আমার বাবারে এক ব্যাগ রক্ত দেয়। হে নিজে দ্যায়। আমার মায় সেই ডাক্তারের পা ধইরা কয়, "বাজান আপনি আমার ধর্মের বাপ। আপনার ঋন আমি কেমনে শোধ করুম বাজান"...।
আমার বাহে আর বাছেনা। পরের দিন মারা যায় হাসপাতালে। মারা যাওয়ার সময় আমার বাহে আমারে কাছে নিয়া মাথায় হাত বুলাইয়া কয়,
"বাজান রে মন খারাপ করিস না। এভাবে আর কারো সাইকেল নিসনা। আর মতি মিয়ার টাকাটা শোধ করিস। বাইচা থাকলে টাকা অইলে
একটা সাইকেল কিনিস। আমিতো আর তোরে সাইকেল কিন্যা দিতে পারি নাই"।
"বাজান রে মন খারাপ করিস না। এভাবে আর কারো সাইকেল নিসনা। আর মতি মিয়ার টাকাটা শোধ করিস। বাইচা থাকলে টাকা অইলে
একটা সাইকেল কিনিস। আমিতো আর তোরে সাইকেল কিন্যা দিতে পারি নাই"।
আমি কাইন্দা কাইন্দা কই বাজান আমি আর সাইকেল চালামুনা । আমারে মাফ কইরা দেও।
বশির আর কথা বলতে পারে। মাথা নিচু করে একটা ফোচকা কে কেবল ভাংতে থাকে। মুখে নেয় না।
তারপর...
তারপরের দিন বাজান মারা যায়। বাজানের লাশ টা যে আনুম সেই টাকাটাও ছিলো না। পরে আরেক ডাক্তার আপা আরো দুতিন জনরে কইয়া আমাগো রে টাকা জোগার কইরা দেয়। আমরা বাড়ি চইলা আসি বাবার লাশ নিয়া।
হের পরে আমি একটা জুতার দোকানে চাকুরী নেই। মতি মিয়ার টাকাও শোধ করি। আমার একটা ছোট বইন ছিলো তারে স্কুলে দিই। স্যার আপনি যেমনে কইছেন আপনি ডাক্তার আমার চোখে ফেরেশতার লাহান হেই ডাক্তার স্যার ম্যাডামের ছেহারা ভাইসা উঠে। স্যার আইজকা ফুচকা কিন্তু আমি আপনারে খাওয়ামু...
তোমার হেই ডাক্তার স্যার আর আপারে আর খুইজা পাও নাই...
না স্যার পাই নাই। অন্য হাসপাতালে চইলা যান যান উনারা। আমি অনেক খুঁজছি, আমার মায় ও অনেকবার গেছিলো কিন্তু পায় নাই।
ডাক্তার না, একেক জন ফেরেশতা ছিলো ওই স্যারে আর আফাডা....।
আর কোন দুঃখ নাই...?
না স্যার আর কোন দুঃখ নাই
এখন কি সাইকেল চালাইতে বা কিনতে ইচ্ছা হয়?
না স্যার হয় না। তয় আমার যদি পোলা হয় তাইলে আমি তারে একখান সাইকেল কিনা দিমু। আমি এহন থাইকা ওর লাইগা পয়সা জমাই।
আচ্ছা বশির তোমরা যে এই রাস্তার পাশে ফুটপাতে শোও। ভয় লাগেনা?
কিসের ভয়।
হতে পারে না, যে কোন দুর্ঘটনা। কতই তো হয় এরকন। শুনোনা প্রায়ইতো দেখা যায় ঢাকায় ফুটপাতের উপর দিয়া রাতের বেলা বড়লোকের ছেলে পুলেরা রেইসিং এর নাম কইরা গাড়ি তুইলা দেয়। এক সাথে দুই তিন জন মানুষ কে ঘুমের মধ্যেই মাইরা ফেলে।
হয় হুনি স্যার মাঝে মাঝে। কিন্তু কি করুম স্যার আমরা গিরীব। আমরার জীবনের কি দাম বড় লোকদের কাছে। এইডা ভাইবা ভাইবা অবশ্য মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।
ঠিক আছে। আর রাস্তার পাশে শুয়ো না। বস্তিতে একটা ঘর নিয়ে থাকো।
ঘরতো নিছিলাম। মাসে বাইশশো টেকা দিয়ে। কিন্তু বউ বায়িত যাওয়ায় হেইডা ছাইড়া দিলাম। খামাখা বাইশশো টেকা দেওয়া কি দরকার।
হ্যা তা ঠিক। কিন্তু এভাবে রাস্তাঘাট এ শোয়া ঠিকনা। তুমি আবার ছোট একটা ঘর ভাড়া নাও। ঘরে থাকো। তুমি একজন সুখী মানুষ।
ঠিক আছে স্যার আমি ঘর দেহুম কাইল থাইক্যা। কিন্তু হেইখানে ও তো ডর। বড় লোকরা বস্তির জায়গা দখল করার লাইগা দেখেন না কেমনে মাঝেমাঝে আমাদের সব কিছু আগুন দিয়া জ্বালাইয়া দেয়। পোড়াইয়া মারে। কি করুম স্যার। হেই ডরেইতো পোয়াতি বউটারে বায়িত দিয়া দিছি। কি করুম স্যার, গরীব হোওয়াডাই একটা পাপ।
বশির তোমাকে এখানে খেতে বলায় রাগ করনিতো। অবশ্য তোমাকে আমি এ শহরের সবচেয়ে দামী রেস্টুরেন্ট এর ভি আই পি স্যুটে বসিয়ে গল্প করতে পারতাম, কিন্তু তাতে লাভ হতোনা। তুমি লজ্জা বোধ করতে। এখানে এ পরিবেশে যেমন অবলীলায় তুমি তোমার সব সুখ দুঃখের কথা আমাকে বললে, ঐখানে ওভাবে বলতেনা।
না স্যার কি যে কন। আপনার সাথে কথা আমার আজীবন মনে থাকবো।
বশির ফুচকার বিলটা আমাকে দিতে দেয় না। সে তার বাবাকে রক্ত আর টাকা দিয়ে সাহায্য করা ঐ ডাক্তার স্যার আর আপার ঋন শোধ করতে চায়।
আমি বিদায় নিই তার কাছ থেকে।
আমি বিদায় নিই তার কাছ থেকে।
(চলবে....)
১ম পর্ব পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ ১ম পর্ব লিঙ্ক
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম । এম.বি.বি.এস (ডি এম সি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) সাইকিয়াট্রিস্ট ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
বংশের বাত্তি - ১ম খন্ড পড়তে ক্লিক করুনঃ
৫ম পর্ব পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ ৫ম পর্ব লিঙ্ক
২য় পর্ব পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ ২য় পর্ব লিঙ্ক১ম পর্ব পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ ১ম পর্ব লিঙ্ক