স্পোর্টস ডেস্কঃ ‘ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ।
ক্রিকেটটা ছিল ঘুমের মধ্যেও। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে বলে ওঠে,
‘মা মা জানালা আটকাও, ক্যাচ ধরো, ক্যাচ ধরো।’ এভাবেই ছেলে মেহেদী হাসান
মিরাজের ক্রিকেট-পাগলামির কথা বলছিলেন মা মিনারা বেগম।
গণমাধ্যম এড়িয়ে চলা মিনারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় মিরাজের
ছোট বোন রুমানা আক্তারের সহায়তায়। দুজন মিলেই জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই মিরাজ
অনেক শান্ত। কখনো কারও কথার অবাধ্য হতো না। পড়াশোনায়ও ছিল ভালো।’ তবে
বাবাকে খুব ভয় পেতেন মিরাজ। এ কারণে বাবা বাড়ি ফেরার আগেই বাড়ি আসতেন। বাবা
খেলা পছন্দ করতেন না, তাই বাবার কাছে কখনো ছেলের খেলা নিয়ে নালিশ করেননি
মা। বরং সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছেন।
আর বোনের চোখে মিরাজ সারা বিশ্বের মধ্যে সেরা ভাই।
ভাইবোনের বয়সের ব্যবধান তিন বছর। মাঝেমধ্যে দুজনের ঝগড়া লাগলেও সেটা
সাময়িক। মাঝেমধ্যে একে অপরের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু সেটা
বেশিক্ষণ নয়। মিরাজই আগবাড়িয়ে কথা বলতেন বলে জানান রুমানা।
মিরাজের খেলা-সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং বড় ডায়েরির
আকারে যত্ন করে বাঁধাই করে রেখেছেন বোন। একপর্যায়ে সেটি বের করে দেখান।
রুমানার কাছ থেকেই জানা যায়, মাঝেমধ্যে ভাইবোন মিলে খাটের ওপর পাখা দিয়ে
ক্রিকেট বল খেলতেন। প্রায়ই তাঁদের রেসলিং রূপ নিত সত্যিকার মারামারিতে। এ
নিয়ে থাকত অভিমানও। মা কখনো ভাইবোনের এসব ব্যাপার নিয়ে বকাবকি এমনকি বাবার
কাছেও নালিশ করতেন না।
মিরাজের জন্ম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার আউলিয়াপুর
গ্রামে। জন্মের তিন বছর পর ২০০০ সালে চাকরির জন্য পরিবার নিয়ে খুলনায় বসবাস
শুরু করেন মিরাজের বাবা মোহাম্মদ জালাল হোসেন। এরপর তাঁদের সবকিছু
খুলনাকেন্দ্রিক। বর্তমানে থাকেন খালিশপুরের বিআইডিসি সড়কের দক্ষিণ কাশিপুর
এলাকায় ভাড়া বাড়িতে। মিরাজের খেলাধুলার হাতেখড়িও সেখানেই।
গত রোববার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের পর
সাংবাদিক আর মানুষের ভালোবাসার ‘অত্যাচারে’ অনেকটা ক্লান্ত মিরাজের পরিবার।
তারপরও হাসিমুখেই সবার সঙ্গে কথা বলছেন তাঁরা। সঙ্গে চলছে মিষ্টিমুখ।
মিরাজের বাবা পেশায় ছিলেন একজন গাড়িচালক। বর্তমানে
অসুস্থতার কারণে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ক্রিকেট খুব বেশি ভালো
বোঝেন না। আর মা গৃহিণী। আর্থিক অনটনের সংসার। তাই বাবা চেয়েছিলেন ছেলে
লেখাপড়া শিখে বড় সরকারি চাকরি করবেন। গানের প্রতি আগ্রহ থাকায় মিরাজকে
বানাতে চেয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পীও। তাই ছেলের খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকাটা খুব
ভালো চোখে দেখতেন না তিনি। খেলার ‘অপরাধে’ মিরাজকে অনেক মারধরও করেছেন
তিনি।
বাবা মিরাজের খেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন যখন
মিরাজ অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলার সুযোগ পান। তারিখটা মনে না থাকলেও মিরাজের
বাবা বলেন, ‘মিরাজ যখন অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলার সুযোগ পেল, তখন সে যে
একাডেমিতে খেলত ওই একাডেমির প্রশিক্ষক আল মাহমুদ আমাকে একটি পত্রিকা নিয়ে
এসে মিরাজের সুযোগ পাওয়ার কথা জানান। পত্রিকায় সেটা দেখে চোখে পানি এসে
গিয়েছিল।’
এ কথা বলতে বলতেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মিরাজের বাবা।
কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে রুমাল দিয়ে চোখ
মুছে নেন। আবার শুরু করেন, ‘পত্রিকায় ওই খবর দেখার পর আর মিরাজকে খেলা নিয়ে
কখনো কিছু বলিনি। বরং উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
মিরাজ তাঁর বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতেন। খেলার
সরঞ্জাম রেখে আসতেন কোনো বন্ধুর বাসায়। বাবা বাড়ি আসার আগেই বাড়ি ফিরে বসে
যেতেন পড়তে।
দক্ষিণ কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম
শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর এসএসসি পাস করেছেন ওই এলাকারই নয়াবাটি হাজী
শরীয়তউল্লাহ বিদ্যাপীঠ থেকে। আর চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন দৌলতপুর
দিবা-নৈশ কলেজ থেকে।
মিরাজের ক্রিকেট খেলার আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি কাশিপুর ক্রিকেট
একাডেমি থেকে। এখনো ওই একাডেমির অধিনায়ক তিনি। ওই ক্রিকেট একাডেমির
প্রশিক্ষক মোহাম্মদ আল মাহমুদ বলেন, ‘আট বছর বয়সে এলাকার রাসেল নামের একটি
ছেলের হাত ধরে একাডেমিতে আসে মিরাজ। ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ আর
প্রচণ্ড খেলোয়াড়ি মনোভাব ছিল তার। নির্দেশনাও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। ভদ্র
ও শান্ত স্বভাবের মিরাজকে মাঝেমধ্যে ওর বাবা খেলার মাঠ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে
মারধর করতেন। এত প্রতিবন্ধকতার পরও খেলা থেকে এতটুকু পিছপা হয়নি মিরাজ। আজ
তারই ফল পাচ্ছে সারা বাংলাদেশ।’
খালিশপুর বিআইডিসি সড়কের দক্ষিণ কাশিপুর এলাকার যে গলি
দিয়ে মিরাজদের বাড়িতে ঢুকতে হয়, সেটি দিয়ে রিকশাও যেতে পারে না। টিনের
চালার ওই ভাড়া বাসায় মাত্র দুটি কক্ষ। এরই একটি ঘরের শেলফের ওপর ও মধ্যে
সারি সারি সাজানো রয়েছে নানা জায়গা থেকে পুরস্কার পাওয়া তাঁর ট্রফিগুলো।
দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো মেডেল। এগুলোই যেন ভাঙা ঘরে চাঁদের আলোর
মতো ঠিকরে জানান দিচ্ছে আগামী দিনের ক্রিকেটে আরও কিছু দেওয়ার প্রত্যয়। সুত্রঃ প্রথম আলো