ইমাদ উদ দীনঃ বাবুজি প্রায় প্রতিদিনই চা গাছে ওষুধ দিই। এতে চা গাছের রোগবালাই দূর হলেও আমাদের রোগ ছাড়ে না। রাতে ঘুম হয় না। চোখ জ্বালা পোড়া, বুক জ্বালা, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা করে। আর খেতে অরুচি, হাতে ফোস্কা, পায়ে ঘা, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাবসহ নানা রোগবালাই লেগেই থাকে। আমাদের ক্ষতি হচ্ছে এটা বুঝি। কিন্তু কাজ ছাড়তে পারি না। কাজ ছাড়লে খেতেও পারব না আর বাগানেও থাকতে পারব না। সেফটি না থাকায় খোলা কীটনাশক স্প্রে করাতে তাদের এমন স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এমনটিই জানালেন চা শ্রমিকরা। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া মৌলভীবাজারের চা উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারকারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি চরমে। মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের অধিকাংশ কীটনাশক ব্যবহারকারী শ্রমিকদের নেই কোন সেফটি। চা বাগানে রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনে টিলার চা গাছগুলোতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার মিশ্রিত বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করায় শ্রমিকদের মানবস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। চা বাগানের শ্রমিকরা জানালেন, কোম্পানির নির্দেশে প্রতিদিনই তারা নির্ধারিত (নিরিখ) এক একর জমির পরিমাণ চায়ের টিলাভূমিতে কীটনাশক স্প্রে করে আসছেন। ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক স্প্রে করার কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের জুতা ব্যতীত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক কোনো সামগ্রী সরবরাহ করছে না কর্তৃপক্ষ। তাই শ্রমিকরা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেই কোম্পানির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী মানবজমিনকে জানান, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে উঠা এমন অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির এই বিষয়টি নিয়ে বার বার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু তারা আশ্বস্ত করলেও এমন প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করছেন খুবই কম। বাংলাদেশ শ্রম আইনে শ্রমিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চশমা, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, এপ্রোন, জুতা ইত্যাদি সামগ্রী প্রদানের নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চা শ্রমিকদের অভিযোগ, চা গাছের রোগব্যাধি দূরীকরণ, পোকামাকড় দমন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ঘাস মারার জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক স্প্রে করা হয়। কিন্তু এসব কীটনাশক ব্যবহারে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক কোনো পোশাকই প্রদান করেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া বাগানে এমবিবিএস চিকিৎসক ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় রোগাক্রান্ত শ্রমিকরা চিকিৎসা সেবা থেকেও হচ্ছেন বঞ্চিত।
কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিনই রোদ-বৃষ্টিতে চা বাগানের টিলাগুলোর জঙ্গল ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে গিয়ে তারা নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। কিন্তু বাগানে ভালো চিকিৎসা ও ওষুধ না থাকায় তারা রোগাক্রান্ত হয়েও কাজ চালিয়ে যান। কারণ হিসেবে তারা জানান, যা মজুরি তারা পান তা দিয়ে পরিবারের দু’বেলা ভাতের নিশ্চয়তা থাকে না। আর্থিক এই টানাপড়েনের মধ্যে বাগানের বাইরে গিয়ে কিভাবে নেবেন চিকিৎসা সেবা। তাই নানা রোগবালাই তাদের চিবিয়ে খায়। চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জানালেন এমন অবস্থা সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ দেশের অধিকাংশ বাগানেই কীটনাশক ব্যবহারকারী শ্রমিকদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাগান ব্যাবস্থাপক জানান, নানা কারণে চা বাগানের জায়গা জবর দখল হওয়াতে অল্প জায়গায় কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় এই চিন্তা থেকেই বাগানগুলোতে এখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এমন উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাত্রাতিরুক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, চা বাগানের পার্শ্ববর্তী হাওর ,নদী, বিল কিংবা জলাভূমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার পতিত হয়ে মাছ, সাপ, ব্যাঙসহ জলজ জীববৈচিত্র্যও মারা যাচ্ছে। ফলে চরম হুমকির মুখে পড়েছে চা শিল্পে কর্মরত জনগোষ্ঠীর মানবস্বাস্থ্য, এ অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এ ব্যাপারে কয়েকটি চা বাগান ব্যবস্থাপকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এসব বিষয়ে তারা কিছুই বলতে রাজি হননি। তবে তাদের তরফে অভিযোগ পাওয়া গেল চা বাগান শ্রমিকদের পোশাক প্রদান করা হলেও শ্রমিকরা তা পরিধান করতে চান না। মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, দেহে প্রবেশের প্রতিরোধকারী প্রয়োজনীয় সামগ্রী পরিধান না করে উন্মুক্তভাবে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে মানব দেহে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। উন্মুক্তভাবে বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ক্ষতিকারক পদার্থগুলো মানবদেহে প্রবেশ করে মস্তিস্ক, দৃষ্টিশক্তি, কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর ক্ষতিসাধন করে। তখন নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন ওই প্রয়োগকারী ব্যক্তি। তাছাড়া সঠিকভাবে কীটনাশ প্রয়োগ না করলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

