হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ

হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ
এস আলম সুমন: প্রতিবেশগত সঙ্কটাপণ্ন্ন হাকালুকি হাওরের দক্ষিণ তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের জনসংখ্যাবহুল ও মৎস্যজীবী অধ্যূষিত গ্রাম সাদিপুর। এ গ্রামে প্রায় ৬ শতাধিক জেলে পরিবারের সদস্যরা আর্থিক দৈনদশা ও জরার্জীণ বসত ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছে । মৌলিক অধিকারের কোনটিরই বাস্তবায়ন নেই এখানে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার সচেতনতা, সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন কোনটিই নেই এই গ্রামে। মৎস্য আহরণ, ও বিক্রি করেই চলে এই এলাকার মানুষের জীবনযাপন। প্রাকৃতিক বৈরীতা আর অভাব অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। নেই দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা। তবুও থেমে নেই হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ। সেখানে স্কুলের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান বাড়ছে দিন দিন। উন্নয়ন অগ্রগতি, স্বাবলম্বী এগুলো সবই যেনো শুধু স্বপ্নমাত্র। দারিদ্রপীড়িত এসব মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এগিয়ে আসে এনজিও সংস্থা। তখন তারা নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্নও দেখেন। কিন্তু কিছুদিন পর ভেস্তে যায় তাদের দেখানো সেই স্বপ্ন। এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর নাম করে ভাগ্যের পরিবর্তন হয় এনজিও সংস্থাগুলোর। বার বার সহজ সরল হতদরিদ্র এ মানুষগুলোকে নিয়ে এনজিওগুলো করে প্রতারণা। তাদের অসচেতনতা ও দারিদ্রতাকে পুঁজি করে রমরমা বাণিজ্য চালায় এনজিওগুলো এমনটিই জানালেন এলাকার মৎস্যজীবীরা।
হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ

সরেজমিন সাদিপুর ও মীরশংকরে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ ও উত্তর সাদিপুর গ্রামে প্রায় ৬ হাজার মানুষের বসবাস। অস্বাস্থ্যকর প্রতিটি খুপড়ি ঘরে ৪ থেকে ৫ টি শিশুসহ প্রায় ৭-৮ জন সদস্য গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। ধর্মীয় গোড়ামী এখানে এখনও বিদ্যমান। নেই জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতনতা। ঘরের চারপাশের মেঝে পর্যন্ত দূষিত পানিতে টুইটুম্বর। প্রতিটি ঘরের পাশেই খোলা ল্যাট্রিন। স্যাঁতস্যাঁতে চরম নোংরা পরিবেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন তারা। হাওরে বর্তমানে পোনা মাছ ধরা নিষেধ তাই সেখানকার অনেক জেলেই বেকার।
হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ

এলাকার মৎস্যজীবী রসিম মিয়া, হাসমত, গুলজার মিয়া, রুকন মিয়া, সাহেদ মিয়া, খেজমত, ছানাউল্ল্যা, রুবেল, সেলিম, রশন মিয়া, মিনাজ, মঞ্জু মিয়া বলেন, এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত হাওরে বেড়জাল, কাপড়ি জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু বছরের এ সময় মূলত হাওরে পানি থাকে বাকি মাসগুলোতে পানি নেমে যায়। এসময় আশেপাশের জলাশয় থেকে মাছ শিকার করে বিক্রি করে চালাচ্ছেন সংসার। বর্ষাকাল ছাড়া শুকনো মৌসুমে বিলগুলো ইজারাদারদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সরকারী কোন সহায়তা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক জেলে নিরুপায় হয়ে পোনা মাছ নিধনকারী সিন্ডিকেটের সাথে গিয়ে নিষিদ্ধ জাল েিদয় অবৈধভাবে হাওর থেকে পোনা মাছ শিকার করছেন। প্রায়ই প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে সিন্ডিকেটের মূলহোতারা থাকেন ধরা ছোয়ার বাহিরে। জেল-জরিমানা গুণতে হয় জেলেদের। এসময় যদি হাওর পাড়ের জেলে পরিবারগুলোকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হত তা হলে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা পেত তারা। রক্ষা পেত দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মাছ। তারা আরও জানান, হাওরে আগের মত পাওয়া যায়না মাছ। মাছ শিকারের পর প্রতিদিন বিক্রি করে অর্ধেকের বেশি টাকা দিয়ে দিতে হয় নৌকা ও জালের মালিককে। বাকি টাকা দিয়ে কোনমতেই চলে জীবন। ‘জাল যার জলা তার’ এ নীতি না থাকায় তারা স্বাধীনভাবে আগের মত ধরতে পারেন না মাছ। ইজারাদারদের বাধার কারণে মাছ ধরাতো দূরের কথা জাল নিয়ে বিলের আশপাশেও যাওয়া যায়না। হাকালুকির বিলগুলো মৎস্যজীবী সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে বিপুল টাকার বিনিময়ে ইজারা নেয় রাঘব বোয়ালরা। এসব রাঘব বোয়ালরা হাওরের মাছের যত্ন না করে সব লুটেপুটে খায়। তারা আরও বলেন, দারিদ্রপীড়িত হওয়ায় তাদেরকে সাবলম্বী ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার নাম করে প্রায়ই বেশ কয়েকটি এনজিও সংস্থা তাদের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে চালায় রমরমা বাণিজ্য।
হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ

কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সুলতান মাহমুদ জানান, উপজেলা প্রশাসনের তহবিল থেকে গত বছর সামান্য অনুদান দেয়া হলেও এবছর কোন অনুদান দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে হাওরের মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য বছরের এসময় যাতে জেলেরা নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা ও মা মাছ না ধরে সেজন্য তাদেরকে সরকারীভাবে অনুদান প্রদান করা হয় এজন্য উর্ধ্বতন কৃর্তপক্ষের কাছে বিষয়টি জানিয়েছি। আগামী বছর থেকে অনুদান দেওয়া যাবে বলে আশা করছি।
হাকালুকির মৎস্যজীবীদের জীবন যুদ্ধ

Post a Comment

Previous Post Next Post