বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান

বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান
অনলাইন ডেস্কঃ গেল বছর মুক্তি পাওয়া বলিউডের বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমাটি অগণিত দর্শকের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। সেই সিনেমায় একজন বজরঙ্গি ভাইজান (সালমান খান) পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে হারিয়ে যাওয়া বাক্প্রতিবন্ধী ছয় বছরের এক শিশুকে তার মা-বাবার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে পরিবার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে নানাভাবে হেনস্তা ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল।
এবার বাস্তবের এক বজরঙ্গি ভাইজানের খোঁজ মিলেছে বরগুনায়, যিনি এরই মধ্যে ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজানের’ খ্যাতি পেয়েছেন।
৫২ বছর বয়সী এই বজরঙ্গি ভাইজানের নাম জামাল ইবনে মুসা। তাঁর বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামে। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ছয় বছর আগে পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসা ১১ বছর বয়সী (বর্তমান বয়স) এক শিশুর তার মা-বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। এ জন্য মুসাকে কম খেসারত দিতে হয়নি। দুটি মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন ১ মাস ২৪ দিন। হারাতে হয়েছে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানির চাকরি। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। নিজের পয়সায় দিল্লি গেছেন এবং ১৫ দিন দিল্লির পথে পথে ঘুরে খুঁজে বের করেছেন সনুর মা-বাবাকে।
মুসার বিষয়ে জানতে গত শনিবার এই প্রতিবেদক যান বরগুনার বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামে তাঁর বাড়িতে। সনুর কাছ থেকে পাওয়া অস্পষ্ট কিছু তথ্যের ভিত্তিতে তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে ১৪ মে দিল্লি গেছেন মুসা।
মুসা দিল্লি থেকে মুঠোফোনে জানান, ২০১০ সাল থেকে সনু থাকত তাঁর প্রতিবেশী হাসি বেগমের বাসায়। সেখানে তার ওপর নির্যাতন করা হতো। বিষয়টি গ্রামের অনেকেই জানতেন। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করলেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিতেন হাসি। তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। যখনই বাড়ি যেতেন, তখন ছেলেটির ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখতেন। এরই মধ্যে একটি তুচ্ছ ঘটনায় তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে মামলা দেন হাসি বেগম। বিষয়টি নিয়ে তিনি খুব অস্বস্তিতে ছিলেন।
মুসা বলেন, মারধর ও নির্যাতনের কারণে শিশুটি প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত। আবার খুঁজে আনা হতো তাকে। গত বছর নভেম্বরের শেষ দিকে সনু পালিয়ে যাওয়ার পর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন হাসি। গ্রামের অন্যদের মতো মুসাও তখন সনুকে খুঁজতে শুরু করেন। ২৯ নভেম্বর বরগুনা শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি চায়ের দোকান থেকে সনুকে উদ্ধার করেন তিনি। সেখান থেকে তাকে নিয়ে স্থানীয় সাংসদের বাসায় রাখেন। এরই মধ্যে ঢাকায় গিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর পরামর্শে সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে বরগুনার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে সনুকে হাজির করেন। আদালত সনুকে যশোরের কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মুসা বলেন, সনুকে আদালতে হাজির করার দিন আদালত থেকে বের হওয়ার পর আগের একটি মারামারির মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করানো হয়। ওই মামলায় তিনি ১৯ দিন জেলহাজতে ছিলেন। এরপর সনুকে অপহরণ করার অভিযোগ এনে গত ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ছেলে ফেরদৌস (২৬), শ্যালক জাহাঙ্গীর, তাঁকেসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে বেতাগী থানায় অপর একটি মামলা করেন হাসি বেগম। ওই মামলায় ৬ মার্চ বরগুনার অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে হাজির হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ১০ এপ্রিল তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর প্রস্তুতি নিয়ে সনুর মা-বাবার খোঁজে রওনা হন দিল্লির উদ্দেশে।
মুসা মুঠোফোনে বলেন, অনেক খুঁজে ১৯ মে দিল্লির দিলসান গার্ডেন নামে একটি এলাকায় খোঁজ পান সনুর বাবা মেহবুবের। মেহবুব সেখানে একটি গাড়ি মেরামত কারখানার শ্রমিক। সনুর ছবি দেখালে মেহবুব প্রথমে চমকে ওঠেন। হাতের কাজ ফেলে আনন্দে তাঁকে (মুসা) বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। পরে তাঁকে নিয়ে যান সনুর মা মমতাজের কাছে। এবার মেহবুব ও মমতাজ হারিয়ে যাওয়া ছেলের ছোটবেলার ছবি মুসাকে দেখান। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া ছেলের খোঁজ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হন মেহবুব-মমতাজ দম্পতি।
মুসা বলেন, ‘আমার ও আমার পরিবারের ওপর দিয়ে গত কয়েক বছরে যে ঝড় গেছে, তাতে এখন আর আমার কোনো আক্ষেপ নেই। সনুর মা-বাবা ও প্রতিবেশীদের আনন্দ দেখে আমার সব দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে গেছে।’
যশোর কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, ‘ভারতের দূতাবাস কর্মকর্তারা ২৫ মে এখানে এসে সনুর তথ্য নিয়ে গেছেন। এখন প্রকৃত অভিভাবকদের কাছে তাকে হস্তান্তরপ্রক্রিয়া চলছে।’

Post a Comment

Previous Post Next Post