মাতুর স্বাদে মাতোয়ারা পাহাড়ি টিলার সুস্বাদু ‘জাম্বুরা’

মাতুর স্বাদে মাতোয়ারা পাহাড়ি টিলার সুস্বাদু ‘জাম্বুরা’
ইমাদ উদ দীনঃ পাহাড়ি টিলার পরতে পরতে এখন পাকা জাম্বুরার মৌ মৌ ঘ্রাণ। মৌলভীবাজারের চাষিরা ব্যস্ত পাকা এ ফলের পরিচর্যা আর বাজারজাত নিয়ে। জেলার জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার পাহাড়ি টিলায় ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে জাম্বুরার। পাহাড়ি ওই অঞ্চলের সুস্বাদু জাম্বুরার সুখ্যাতি জেলাজুড়ে। তাই মওসুম এলেই স্থানীয় বাজারগুলোতে চাহিদা ওই এলাকার সুস্বাদু টক ও মিষ্টি স্বাদের রসালো ফল জাম্বুরার। গোলাকৃতির লেবু জাতীয় দেশীয় এ ফলটির নাম জাম্বুরা। স্থানীয়ভাবে মাতু জামির নামে ব্যাপক পরিচিত। এখন চলছে ফলটির ভর মওসুম। গাছে গাছে দোল খাচ্ছে পাকা আধপাকা জাম্বুরা। টক ও মিষ্টি স্বাদের রসালো এ ফসলটির চাহিদাও ব্যাপক। এই দুই উপজেলা ছাড়াও জেলার কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর, মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলে অনেকের বাড়িতে যেমন কম-বেশি চাষ হচ্ছে এ পরিচিত সুস্বাদু জাম্বুরা ফল তেমনি স্থানীয় বাজারগুলোতে এখন জমে উঠেছে এ মওসুমি ফলের ব্যবসা। বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়ার স্থানীয় বাজারগুলোতে এখন চলছে এ মওসুমী ফলটির জমজমাট ব্যবসা। স্থানীয় হাটবারের দিনগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদভারে মুখরিত হচ্ছে ওই এলাকার বাজারগুলো। স্থানীয় ব্যবসায়ী ছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে এ ফল কিনতে আসছেন পাইকাররাও। চাষিরা জানিয়েছেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন হয়েছে ভাল। তারা জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সময়মতো ফল আসায় তা পেঁকেছেও তাড়াতাড়ি। তাই এখন চলছে ফলটির শেষ পর্যায়ের বেচাবিক্রি। তারা আশানুরূপ দামও পাচ্ছেন। লেবু জাতীয় ফসল চাষে সিলেটের এ অঞ্চলের সুনাম ও সুখ্যাতি থাকলেও নানা কারণে তা দিন দিন কমে যাচ্ছে। চাষিরা জানালেন, তারা আগের মতো এখন আর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাইরে রপ্তানি করতে পারেন না। তারপরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থেমে নেই কৃষকদের চাষাবাদ। নিজ হাতে ফলানো পাকা ফসলের মৌ মৌ ঘ্রাণই তাদের সফলতার হাসি। জুড়ীর গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকার পাহাড়ি টিলায় এখন মাতু জামির ‘জাম্বুরা’ বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। এখানকার জাম্বুরা সুস্বাদু ও রসালো হওয়ায় যেমন এর রয়েছে সুখ্যাতি তেমনি রয়েছে চাহিদাও। তাই মওসুম এলেই ওখানকার জাম্বুরার স্বাদ নিতে ভুলেন না ভোজন রসিকরা। জুড়ী উপজেলার রূপাছড়া, লালছড়া, লাঠিছড়া, জরিছড়া, শুকনাছড়া, লাঠি ঠিলা ও বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ও উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোবারতল, কেচিরগুল, জালাই, সাতরাকান্দি, ডিমাই ও পাল্লারতল এলাকার পেকুছড়া, ঘান্দাই, মাজঘান্দাই, ষাটঘর, ইসলামনগর, করইছড়াসহ পাহাড়ি ওই এলাকার অনেক গ্রামেই চাষ হচ্ছে এফল। টক মিষ্টি স্বাদের সুপরিচিত দেশীয় এই ফলের ভেতরের রসাল কোষগুলোর ঘনত্বও বেশি। স্বাদেও রয়েছে ভিন্নতা। জানা যায়, সাইট্রাস গোত্রের এই ফলটি একাধারে যেমন পুষ্টিকর, তেমনি রয়েছে এর নানাবিধ ঔষধি গুণ। রোগ নিরাময় আর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জাম্বুরা বিশেষভাবে কার্যকর। জাম্বুরার বৈজ্ঞানিক নাম ঈরঃৎঁং ঢ়ধৎধফরংর। জাম্বুরা ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল। এর পুষ্টিমান অনেক উন্নত। প্রতি ১০০ গ্রাম জাম্বুরার মধ্যে আছে ৩৭ কিলো ক্যালোরি, শর্করা ৯.২ গ্রাম, মুক্ত চিনি থাকে ৭ গ্রাম, সামান্য খাদ্যআঁশ, প্রোটিন ও ফ্যাট বিদ্যমান। বিটা ক্যারেটিনের পরিমাণ ১২০ মি.লি গ্রাম, ৬০ গ্রাম ভিটামিন ‘বি’ও থাকে। জাম্বুরা ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘এ’ ও পটাসিয়ামের বেশ ভাল উৎস। এ ছাড়া অন্যান্য ভিটামিনের মধ্যে ফলিক এসিড, পাইরিডঙিন ও থায়ামিনও রয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। সেই সঙ্গে আছে খানিকটা আয়রন, ক্যালসিয়াম, কপার ও ফসফরাস। ফলটিতে ক্যালরি কম থাকায় ডায়বেটিস ও স্থলকায়দের জন্য খুবই উপকারী। প্রস্টেটের ক্যানসারসহ নানা রকম অসুখ নিরাময়ে জাম্বুরা অত্যন্ত উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এতে আছে লাইকোপেন, যা এক ধরনের ক্যারোটিনয়েড রঞ্জক, এটি ক্যানসার ও টিউমার ধ্বংসে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। লাইকোপেনের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে ভিটামিন ‘সি’-এর উপস্থিতি, যা জাম্বুরায় ভাল মাত্রায় আছে। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ফলটির দামও সাধ্যের মধ্যে। এখানকার স্থানীয় বাজারগুলোতে একটি ‘মাতু জামির’ জামু্বরা স্থান ও আকার ভেদে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। লাটিছড়ার জাম্বুরা চাষি আবদুল মন্নান, মছব্বির আলী, সায়েব আলী ও মো. ইয়াবুব মিয়া পাল্লারতল এলাকার মো. ফখরুল ইসলাম, আবদুল হাছিব, আব্দুল বাছিত, এখলাছ মিয়াসহ অনেকেই জানান, জাম্বুরা গাছে সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল আসে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে পাকা ফল পাওয়া যায়। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে ২০০-৩০০টি জাম্বুরা ধরে। তারা প্রতি বছর ২০ থেকে ৮০ হাজার টাকার জাম্বুরা বিক্রি করেন। এছাড়া স্থানীয় অনেক চাষিই অল্প পরিসরে নিজ বাড়িতেও চাষ করেছেন এ ফসলটি। চাষিরা জানান, রোগ-বালাই অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির কারণে কোন কোন মওসুমে ফলন কম হয়। অন্যান্য মওসুমি ফসলের চাইতে এ ফল চাষে খরচ ও প্ররিশ্রম কম হওয়ায় এ ফসল চাষ লাভজনক বলে জানান চাষিরা। চাষিদের দাবি স্থানীয় কৃষি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতা ও সময়মতো ন্যাযমূল্যে সার ও কীটনাশক পাওয়ার। তাহলে অনেক আগ্রহী চাষিরা তাদের পতিত পাহাড়ি ঠিলায় লাভজনক এ জাম্বুরা চাষে এগিয়ে আসতেন বলে কৃষকরা দাবি করেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post