ঘরে ঘরে জ্বর; মৌসুমি, ডেঙ্গু নাকি করোনা



ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী: ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রকৃতির হাওয়া বদল হতে শুরু করেছে। আকাশ ভরা রোদ তো আবার ঘন বর্ষার হাতছানি। দেখা যাচ্ছে দিনের বেলায় প্রচুর গরম, আবার তার ভেতরে হঠাৎ বৃষ্টি চলে এলো। কেউ কেউ একটু বৃষ্টিতেও ভিজলেন; আবার প্রচুর গরম থেকে ঘেমে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।

তাছাড়া বাইরের প্রচণ্ড গরম থেকে ফিরে অনেকে বাসায় বা অফিসে গিয়ে এসির নিচে বসে যান। এই যে তীব্র গরম আর হঠাৎ ঠান্ডার একটা সংমিশ্রণ হয়েছে-এখান থেকেই জ্বর-সর্দি চলে আসতে পারে।

আবহাওয়া পরিবর্তনের এই গরম ঠান্ডার মধ্যে প্রায় প্রতিটি পরিবারে মৌসুমি জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের দৈনন্দিন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় গত কয়েক দিন ধরে জ্বর-সর্দি-কাশি এবং শরীর ব্যথার উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী প্রচুর দেখা যাচ্ছে। এই জ্বর ভাইরাস দ্বারা দ্রুত একজনের মাধ্যমে আরেকজনে সংক্রামিত হয়। তবে বরাবরের মতো কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে এমন ভাইরাল জ্বরের প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ভাইরাস জীবাণুর সংক্রমণের ফলে এই সর্দি-জ্বর সাত দিন স্থায়ী হতে পারে। ঔষধ ও পুষ্টিকর খাবার খেলে এই সময়ের মধ্যে জ্বর ভালো হয়ে যায়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে এই জ্বর-সর্দিতেই যদি কোভিড আর ডেঙ্গির পরীক্ষাটা করে ফেলা যায়, তাহলে আর কোনো দ্বিধা থাকবে না। শুরুতেই যদি পরীক্ষাটা করে নেওয়া যায়, তাহলে পরে জটিলতা সৃষ্টি হয় না।

মৌসুমি ভাইরাল জ্বরের লক্ষণ : হঠাৎ জ্বর আসে এবং সাত দিন ধরে চলতে থাকে। ১০২-১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর হয়। শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এ জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা থাকে। অনেক সময় সাথে গলা ব্যথাও থাকতে পারে। গায়ে, হাত, পায়ে তথা শরীরের পেশিতে অসহ্য ব্যথা করে। তবে এবারের জ্বরের শরীর ব্যথাটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসেছে। জ্বরে আক্রান্তদের ইতিহাস নিলে শোনা যায় প্রচণ্ড শরীর ব্যথায় মনে হয় কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে, কেউ কেউ বলছেন জয়েন্টগুলো মনে হচ্ছে খুলে নিয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগেরই জ্বরের সঙ্গে পায়ে ব্যথা দিয়েই ফ্লু শুরু হচ্ছে।

বেশির ভাগ সময় শরীরে জ্বরের সঙ্গে সর্দি, কাশি থাকে। শুকনো কাশির যন্ত্রণার কথা বেশি শোনা যাচ্ছে এবারের ফ্লুতে। গরম-ঠান্ডার হাওয়া বদলে নাক বন্ধ থাকে; নাক দিয়ে পানি পড়ে। মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে খিদে কমে যায় ও বমি বমি ভাব থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে মুখ লাল হয়ে যায়।

চিকিৎসা ও সাবধানতা : জ্বর কখনোই বাড়তে দেওয়া যাবে না। জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুরো শরীর নরম কাপড় কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে মুছে ফেলতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বর ও ব্যথা কমার ওষুধ খেতে হবে। এজন্য বাসায় প্যারাসিটামল ট্যাবলেট রেখে দিতে পারেন।

মারাত্মক জ্বর হলে বয়সভেদে প্যারাসিটামল সাপোজিটোরি পায়ুপথে ব্যবহার করা যেতে পারে যা নিরাপদ। তবে মনে রাখবেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো এন্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে আপনার পারিবারিক চিকিৎসকের পরামর্শ প্রথমে নিতে পারেন। নাক বন্ধ থাকলে নাকের ড্রপ ব্যবহার করা লাগতে পারে। গলা ব্যথা থাকলে কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করতে হবে।

দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক রাখতে হবে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় পুষ্টিকর খাবার, সেজন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এই সময়ে আদা-লেবুর সংমিশ্রণে রং চা খেতে পারেন।

অসুস্থ ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই সময়ের জ্বরে অবশ্যই রোগীকে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। এ সময় ডাবের পানি অত্যন্ত উপকারী পানীয় হিসাবে কাজ করে। বাইরের খাবার খাওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে।

এদিকে বলা হচ্ছে, করোনার সংক্রমণ আবার হুমকি দিচ্ছে। তাই এবারের মৌসুমি জ্বরের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে বাড়তি সতর্কতা হিসাবে আমাদের উচিত ব্যক্তিগত সুরক্ষা মেনে চলা। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া যারা এখনো করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ বা বুস্টার (তৃতীয়) ডোজ গ্রহণ করেনি তাদের দ্রুত তা নেওয়া উচিত।

ঘরে মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত রোগী থাকলে তাকে ভিন্ন ঘরে রেখে পরিচর্যা করা উচিত। মৌসুমি জ্বর ছোঁয়াচে নয়, তবে রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। মশার ব্যাপারেও এ সময় চাই বাড়তি সতর্কতা।

লেখক : রেজিস্ট্রার, নাক-কান-গলা বিভাগ, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট।

Post a Comment

Previous Post Next Post