এ কে এম জাবেরঃ আলহামদুলিল্লাহ... সকলের দোয়ায় আমি করোনা পজেটিভ থেকে ভালো হয়েছি। এখন স্বাভাবিকভাবে সকল কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছি। আমি একজন স্বাস্থ্যকর্মী, দেশের সবকিছু যখন বন্ধ তখন পেশাগত দায়িত্ব পালনে, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গিয়েই কিন্তু আমি আক্রান্ত হয়েছি। এটাই ভালোলাগার বিষয়, এটাই আত্মতৃপ্তি।
মে মাসের ৫ তারিখ, দিনটা মঙ্গলবার হলেও আমার কাছে মঙ্গলজনক ছিলোনা বরং আতঙ্কের ছিলো। রমজার মাস তাই সেহরি খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমানোর কারণে একটু দেরীতেই ঘুম থেকে উঠে অফিসে আসলাম। অফিসে এসে একটু ঘোচানোর কাজে ব্যস্ত যখন ঠিক তখনই কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুরুল হক মহোদয়ের ফোন পেলাম। ফোন পেয়েই যথারীতি সালাম-কুশলাদি বিনিময় করতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন
- জাবের কেমন আছো? আমি বললাম আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় আছি। অফিসে শোনার পর বললেন, জাবের তুমি বাসায় চলে যাও, তোমার করোনা রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। শোনার পর পরই শরীরে কেমন জানি অনুভব হলো, গলা বসে যাচ্ছে। এমন সময় স্যার বললেন ভয়ের কোনো কারণ নেই, তোমার যেহেতু কোনো সিম্পটম নেই এবং প্রায় ১০ দিন চলে গেছে সেহেতু তুমি এখন নিরাপদ এটা বলা যায়। এই কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বাসায় আসলাম। রুমে এসেই গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ পরলাম।
মানসিকভাবে কি পরিমাণ চাপের মধ্যে পড়ে গেলাম তা লিখে বুঝানো যাবে না। বাসায় আসার পর প্রথমে কাকে বলবো, বলবো কি না, বলতেই তো হবে এসব ভাবতে লাগলাম। ফোন দিলাম সহকর্মী ও প্রিয় ছোটভাই রাহাত ও কাশেম ভাইকে। তারাও এই কথা শুনে চিন্তিত কারণ আমরা প্রায় সময়ই এক সাথে থাকি ও চলাফেরা করি। মনে সাহস নিয়ে আমার ছোট ভাই জাহানকে সবকিছু বললাম, কিভাবে কি করতে হবে সবকিছু আলাপ আলোচনা করলাম। ইতিমধ্যে স্যার আরো কয়েকবার যোগাযোগ করলেন। পরিবারের সবার স্যাম্পল দেয়া হলো।
ইতিমধ্যে কুলাউড়ায় একজন করোনা পজেটিভ এমন সংবাদ 'টক অব দা টাউনে' পরিণত হলো। আমি ক্লিনিকে কাজ করার পাশাপাশি, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে কাজকর্ম করে থাকি। একেতো আমি অনেক টেনশনে আছি এর পরে অনেকেই আমার মোবাইলে কল দিয়ে জানতে চাচ্ছেন কুলাউড়ায় একজন করোনা পজেটিভ সে মানুষটি কে? আমি নির্বাক, কি উত্তর দিবো। স্বাস্থ্য বিভাগের অনেকেই জেনে গেছে যে আমিই করোনা পজেটিভ। সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শাহজাহান কবির স্যার, সত্যকাম চক্রবর্তী স্যারসহ স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অনেক সহকর্মী কল দিয়ে পরামর্শ ও সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমার বাসা লকডাউন করা হয়েছে। বিকেল-সন্ধ্যার মধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন যে লোকটি আমি।
দেশে প্রবাসে থাকা সকল প্রিয়জন, ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, সবাই আমাকে নিয়ে অনেক উদ্ধিগ্ন। অনেকেই মোবাইলে কল দিচ্ছেন, মেসেজ দিচ্ছেন। অনেক জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম জগতের সহকর্মী, প্রশাসনের ভাইয়েরা, স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক প্রিয় স্যার/ম্যাডাম, সারাদেশ থেকে সকল প্রিয় সহকর্মীরা বার বার কল দিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাই-বন্ধু, প্রিয়জন, পরিচিত-অপরিচিত, অনেকেই শুভকামনা জানিয়েছেন, দোয়া করেছেন সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিশ্বে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে কুলাউড়া চাতলাপুর চেকপোস্টে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধকল্পে মেডিকেল টিমে দায়িত্ব পালন করেছি। কুলাউড়ায় প্রথম সনাক্তকৃত রোগীরা যেদিন কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলো সেদিন আমিও হাসপাতালে ছিলাম এবং তাদের সংস্পর্শেও এসেছিলাম। শরীরে একটু জ্বর জ্বর অনুভূত হলে আমি এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ স্যাম্পল দিয়েছিলাম আর রিপোর্ট আসলো ৫ মে মানে ১০ দিন পরে। এবার আসি আমার চিকিৎসার কথায়। কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুরুল হক মহোদয়ের পরামর্শমতে আমি আমার ঘরেই আইসোলেশনে আছি। আর ইতিমধ্যে আমি পুরোপুরি সুস্থ, আমার যেহেতু এখন কোনো সিম্পটম্প নেই তাই আমাকে কোনো ধরনের ঔষধ গ্রহণ না করার পরামর্শ দেয়া হলো। ডাঃ সত্যকাম চক্রবর্তী, ডাঃ মোহাম্মদ শাহজাহান কবীর চৌধুরী, ডাঃ মোহাম্মদ সাইদ এনাম, ডাঃ মোহাম্মদ নাদিম মিয়া, ডাঃ প্রদিপ চৌধুরী, ডাঃ সুমাইয়া বিনতে জাহান, ডাঃ মমতাজ মুন্নি, ডা. আবু নাসের রাশু সহ অনেক প্রিয় চিকিতসক সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিচ্ছেন, বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের পরামর্শ মতে আমি একটু পর পর লবণাক্ত গরম পানি দিয়ে গড়গড় করছি, রঙ চা খাচ্ছি, ভিটামিন সি জাতীয় ফল/খাবার খাচ্ছি। সব সময় গরম পানি ব্যবহার করছি। গরম পানির ভাপ নিচ্ছি (গরম পানির ভাপ নাকের মধ্য দিয়ে টেনে ফুসফুসের মধ্যে প্রবেশ করানো, যাতে সেখানে কোন করোনা ভাইরাসের জীবাণু ঢুকে থাকলে তা নিঃশেষ হয়ে যায় বা নিস্তেজ হয়ে যায়, গরম পানির ভাপ নিতে হবে ১০ মিনিট প্রতিবারে, দিনে চারবার)। আমি আমার পরিবারের সবাই কমপক্ষে ২০ বার নাকের মধ্যে ভাপ নেওয়ার এই ঘরোয়া চিকিৎসা করাতে থাকলাম। পাশাপাশি কিছুক্ষণ পরপর হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে নামাজ পড়ে বাসার মধ্যেই অবস্থান করতে থাকলাম।
আমিসহ আমার পরিবারের সবাই মোটামুটি মানসিকভাবে স্ট্রং আছি আল্লাহর উপর ভরসা। আত্মীয় স্বজন সবাই-ই খোঁজ খবর নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিষয়টি প্রায় সবাই পজেটিভলি নিলেও হাতেগোনা কয়েকজন হয়তো ভয়ে একটু অন্যরকমভাবে নিয়েছে। তাদের নাম পরিচয় নাই বা বললাম। আমার আত্মীয়দের বাড়ির আশে পাশে অনেকেই একটু কেমন কেমন অন্যরকম কথাবার্তা, চাহনী এই আর কি! যাই হউক আমি একজন স্বাস্থ্যকর্মী, দেশের সবকিছু যখন বন্ধ তখন পেশাগত দায়িত্ব পালনে, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গিয়েই কিন্তু আমি আক্রান্ত হয়েছি। এটাই ভালোলাগার বিষয়, এটাই আত্মতৃপ্তি।
আমার ভাইদের প্রায় সকল বন্ধুরাই ভালো মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে। অনেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এনে দেওয়ার জন্য বলেছেও। সবার মনেই করোনা আতঙ্ক তাই হয়তো একটু বেশি খোঁজখবর নিয়েছে। অনেকে সেলফ কোয়ারেন্টাইনেও গিয়েছে নিজেদের সতর্কতার জন্য। সেটাও ভালো আর বিপদে বন্ধুর পরিচয় তাও প্রমাণিত।
অনেক কাছের প্রিয়জন প্রতিদিন খবর নেয়ার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়েও সহযোগিতা করেছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে অনেক প্রিয় সহকর্মী খোঁজ খবর নিচ্ছেন। বন্ধু নাজমুল বারী সোহেল, গণমাধ্যমকর্মী শরীফ আহমেদ, আমেনা মিষ্টিঘরের জাহের আলম চৌধুরী মামা, খোকন ভাই, প্রবাসী প্রিয় ভাই ফয়েজ আহমেদ তপন, রিপন প্রতিদিনই খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগান দিচ্ছেন। আমারা যে বাসায় থাকি সে বাসায় ১২টি ফ্লাট, সারা বাসা লোকডাউন থাকায় অনেকের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার সংকটের সৃষ্টি হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ৪টি পরিবারের জন্য খাবার পাঠালেন।
২য় বার স্যাম্পল দিলাম ৫ মে, আজ ১৫ মে রাত এখনো রিপোর্ট আসে নাই। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও মানসিকভাবে আর সুস্থ থাকা যাচ্ছে না। কাকে দোষবো বুঝতে পারছি না, সবই প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়! অবশেষে আমাদের পরিবারের সকলের রিপোর্ট নেগেটিভ আসলো। শারিরিকভাবে সুস্থ থাকার পরও রিপোর্ট নেগেটিভ শোনার পর মানসিকভাবে সুস্ত হলাম। দুঃশ্চিন্তা দূর হলেও আমিসহ পরিবারের সবাই অত্যান্ত সতর্কতার সহিত চলাফেরা শুরু করলাম।
আমি উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্ণধার ডাঃ মোহাম্মদ নুরুল হক মহোদয়ের কাছে অত্যান্ত কৃতজ্ঞ। ১৭ মে আমাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেকে নিয়ে করোনা থেকে মুক্ত ঘোষনা করেন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের প্রিয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে কাজে যোগদানে উতসাহিত করেন।
এই কতোদিনে অনেক অভিজ্ঞতা হলো, অনেক অজানা জিনিস জানলাম, শিখলাম, বুঝলাম। অনেক আপনজনকে নতুন করে চিনলাম। অনেক কাছের মানুষ দূরে চলে গেলো, অনেক দূরের মানুষ কাছে এলো। সবকিছুর পরে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের কাছে শুকরিয়া যে আমাকে এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে সুস্থতার সহিত উদ্ধার করেছেন। এই সময়ে যারা আমার খোঁজ খবর নিয়েছেন, বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেছেন, আমার জন্য দোয়া ও শুভকামনা করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। সকলের এই ভালোবাসায় আমি আপ্লুত। আপনাদের কাছে আমি চির ঋণী হয়ে গেলাম...
লেখকঃ এ কে এম জাবের
akmjaber@gmail.com