‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছেলে এ প্রজন্মের করোনাযোদ্ধা’


এস আলম সুমন: ৭১ এ দেশ ও জাতির স্বাধীনতার জন্য বাবা জীবন বাজি রেখে মুক্তযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের লড়াইয়ে আমরা একটি স্বাধীন মানচিত্র ও পতাকা পেয়েছি। আমি তো সেই বাবার সন্তান। ৭১ তো পাইনি। তবে বিশ্ব মহামারী ও অদৃশ্য শত্রু করোনার বিরুদ্ধে লড়ছি। বিশ্বাস এটাই করোনাকে পরাজিত করে আমরা জয়ী হব। ইতিমধ্যে অনেকে সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটা আশা জাগাচ্ছে। একদিন করোনার আঁধার কেটে যাবে।’
কথাগুলো বলছিলেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সুপরিচিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরোটরি) সাইদুর রহমান চৌধুরী। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সদের সাথে করোনাযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা মেডিকেল টেকনোলজিস্টরাও।
মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান এই প্রেরণায় নিজেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন করোনার বিরুদ্ধে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি কুলাউড়ার ২১৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। আর এ জন্য প্রায় দুই মাস ধরে পরিবার,স্বজন ও সন্তানকে ছেড়ে আলাদা বাসায় থাকতে হচ্ছে সাইদুর রহমানকে।

করোনার সংক্রমণ শুরু হলে সাইদুরের ওপর নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে। ঝুঁকি আছে জেনেও পেশাদারিত্ব আর মানবতার টানে হাসিমুখেই এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন। নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়ার পর শহরে আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানে একা থাকেন। নিজে রান্না করে খান। এ কাজে তাঁকে উৎসাহ জোগান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরুল হক। নমুনা সংগ্রহের সময় উপজেলার স্যানিটারি পরিদর্শক জসিম উদ্দিন তাঁকে সহযোগিতা করেন।

সাইদুর রহমান জানান, তাঁদের মূল বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার পুরানগাঁও গ্রামে। তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান চৌধুরী কুলাউড়া জংশন রেলওয়ে হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অবসর নেন। সেই সুবাদে তাঁদের কুলাউড়ায় বসবাস। বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে হলেও দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের সুবাদে কুলাউড়াই তাঁর প্রাণের শহর। সাইদুর ২০০৮ সালে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের চাকরি পান। তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তার কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা। তাঁদের সংসারে আছে তিন ছেলে।

তিনি বলেন, মার্চ মাস থেকে ২০ মে বুধবার পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ২১৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৪ জনের ফলাফল পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে আটজনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় দফা পরীক্ষায় তাঁদের পাঁচজনের ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। অন্যদের দ্বিতীয় দফা পরীক্ষার ফলাফল এখনো মেলেনি।
তিনি আরো বলেন, দায়িত্ব থেকে কখনো পিছপা হবোনা। যখন যে দায়িত্ব দেয়া হবে সেই দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট রয়েছি। করোনাকে জয় করতে হলে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থবিধি মানতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে।

জানা যায়, চাকরির পাশাপাশি ‘নিরাপদ স্বাস্থ্য রক্ষা আন্দোলন’ নামে জনপ্রিয় একটি রক্তদানকারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিনিয়র সহসভাপতি তিনি। ২০১৪ সালের ১ মার্চ এ সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। এর সদস্য এখন ২০০ জন। সংগঠনের কাজ স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। সংগঠনের তালিকাভুক্ত এক হাজার রক্তদাতা রয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বিনামূল্যে রক্ত দেন। সংগঠনের উদ্যোগে প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। এছাড়াও থ্যালাসমিয়া রুগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ ও তাঁদের রক্ত প্রদানে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ডা. মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহে সাইদুরই এখন আমাদের ভরসা। করোনা মোকাবিলায় আমাদের মতো স্বজনদের সঙ্গ ছেড়ে তিনিও নিরলসভাবে লড়ছেন।’

Post a Comment

Previous Post Next Post