এমদাদুর রহমান চৌধুরী জিয়া: ঐতিহ্যবাহী এক ক্লাবের নাম সিলেট ষ্টেশন ক্লাব। যেখানে বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিগাতা। দেশের আরে কোনো ক্লাবে এতো বেশি মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত আছে কি না তা আমার জানা নেই।
চায়ের দেশ খ্যাত সিলেটে ইংরেজ টি প্লানটাররা তাদের ব্যবসায়ীক মিলন ও বিনোদনের জন্য যেটি ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতেন বলেই তার নাম করণ করা হয় সিলেট ষ্টেশন ক্লাব। এই ক্লাবের রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় তৎকালীন অবৈতনিক সম্পাদক জি. এইচ ভ্যালন্টাইন সিলেটে শহরের তেলিহাওর নিবাসী মহেন্দ্র নাথ দাস ও শেখঘাট নিবাসী বনোয়ারী লাল দাস ও বিনোদ লাল দাসের কাছ থেকে ১৯১৬ সালে ক্লাবের জন্য এক বিঘা ১২ কাঠা ৮ ছটাক জমি সংগ্রহ করে আইনী মালিকানা সৃষ্টি করেন।
চায়ের দেশ খ্যাত সিলেটে ইংরেজ টি প্লানটাররা তাদের ব্যবসায়ীক মিলন ও বিনোদনের জন্য যেটি ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতেন বলেই তার নাম করণ করা হয় সিলেট ষ্টেশন ক্লাব। এই ক্লাবের রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় তৎকালীন অবৈতনিক সম্পাদক জি. এইচ ভ্যালন্টাইন সিলেটে শহরের তেলিহাওর নিবাসী মহেন্দ্র নাথ দাস ও শেখঘাট নিবাসী বনোয়ারী লাল দাস ও বিনোদ লাল দাসের কাছ থেকে ১৯১৬ সালে ক্লাবের জন্য এক বিঘা ১২ কাঠা ৮ ছটাক জমি সংগ্রহ করে আইনী মালিকানা সৃষ্টি করেন।
আবার ১৯৫৩ সালে ক্লাবের অবৈতনিক সম্পাদক ক্যাপ্টেন রশিদ আহমদ শেখঘাট এলাকার বাবু বনবীর লাল দাসের বিধাব স্ত্রী পারুল বালা দাসের কাছ থেকে ২ বিঘা ৭ কাটা জমি সংগ্রহ করলে যাত্রা শুরু হয় আধুনিক এক ক্লাবের। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ১৯৪৮ সালে ক্লাবটির দায়িত্ববার গ্রহণ করেন সিলেটের সুনামধন্য ৯ জন ব্যক্তি। তৎকালীন সিলেটের ডিসি খুর্শেদের মধ্যস্থতায় মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন যারা তারা হলেন আমিনুর রশীদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন রশিদ আহমদ, খান বাহাদুর আব্দুল হাই চৌধুরী, বনবীর লাল দাস, বিমলাংশু সেনগুপ্ত, কালিপদ চৌধুরী, রণেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী, সমরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী এবং বিনোদ লাল দাস। এসব পুরুষ কেউ আজ আর বেছে নেই। শুধু স্মৃতির পাতায় যেন ষ্টেশন ক্লাবের ইতিহাসে স্বর্ণক্ষরে লেখা তাদের নাম। ১২৫ বছর পূর্তি উৎসব করেছে এ ক্লাব অনেক আগেই।
সমাজ কল্যাণ সংস্থা থেকে নিবন্ধিত সিলেট ষ্টেশন ক্লাব মানবিক ও সামাজিক সব উদ্দ্যেগের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করে চলছে। যে ক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা, বিচারপতি থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনার ম্যান পাওয়াররা সাম্প্রিত্ত রয়েছে। সিলেটের সামাজিক অঙ্গনে রয়েছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহ্য।
বর্তমান সময়ে ঢাকার অলি-গলিতে গড়ে ওঠা ক্লাব গুলো ষ্টেশন ক্লাবের মতো সুনামধন্য ক্লাবের ঐতিহ্য ধ্বংস করে দিচ্ছে সামাজিক অঙ্গনে। ক্লাব পাড়া মানে ক্যাসিনো আর অসামাজিকতা এমন ধারণার সৃষ্টি করছে আজকালের ক্যাসিনো স¤্রাটেরা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আগেকার সময়ে ক্লাব সংগঠনে কাজ করতো যুবকরা আর অর্থের যোগান দিতো অভিবাকরা। অতিথি করা হতো অনুষ্ঠান করে সুনামধন্য ধণাঢ্য ব্যক্তিদের।
সিলেট ষ্টেশন ক্লাব দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত ও প্রাচীন ক্লাবগুলোর মধ্যে একটি। দেশের বরণ্য ক্লাব গুলোর মধ্যে প্রথম সারীর ক্লাবের মধ্যেই যার অবস্থান বললে চলে। এ ক্লাবের ঐতিহ্য ও সুনাম দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। শুধু বিনোদনই নয় আর্ত্মসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ ক্লাবের ভূমিকা প্রশংসার দাবী রাখে। সহায়তা করা হয় ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী অসহায় দুস্থদেরও।
ক্লাব সংগঠনের সেই শিষ্টাচার আজকের প্রজন্মের কাছে ক্যাসিনো নামে খ্যাত। কিন্তু এদের মধ্যেও দেশের ব্যতিক্রমী নীতি-নৈতিকতা নিয়ম-কানুনের মধ্যে আবদ্ধ ক্লাব গুলোর মধ্যে একটি সিলেট ষ্টেশন ক্লাব।
এখন ক্লাব নামধারী স্থানে আবিস্কার হয়েছে অপরাধ জগতের আস্তানা। আইনশৃংখলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় এসব অপরাধ পরিচালনা হয়ে আসলেও ইদানিং এর শুদ্ধি অভিযানে বেরিয়ে আসলো ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো পরিচালনার ফিরিস্তি। কোটি কোটি টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক নেতারা। উদ্ধার হয়েছে অস্ত্র, মাদকসহ আরও অনেককিছু। এসব দেখে সঙ্গত কারণেই ক্লাবের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরূপ ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছে ক্লাব মানেই জুয়া, ক্লাব মানেই অপরাধীদের আস্তানা। কিন্তু না, তাদের এ ধারণা পরিবর্তনের জন্য সিলেট ষ্টেশন ক্লাবই যতেষ্ট। সরেজমিনে সিলেট ষ্টেশন ক্লাবে দৈনিক সংবাদ এর বিশেষ প্রতিনিধি আকাশ চৌধুরী, অপরাধ বিচিত্রার সিলেট ব্যুারো চীফ নুরে আলম খোকন, সাংবাদিক ইদ্রিছ সহ মিডিয়ার একটি টিমকে নিয়ে আমি অনুসন্ধানে গেলে দেখা যায় প্রাণবন্দ এই পরিবেশ।
এসব ক্লাবের নেতৃত্বে থাকা সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেকেই স¤্রাটের ক্যাসিনোর কালো ধোয়ায় আজ প্রশ্নবৃদ্ধ। কিন্তু তার জন্য কি বাদ পড়ে যাবে দেশের সভ্যসমাজের ঐক্যের বন্ধন ক্লাব সংগঠন? ২০০৬ সালে সিলেট ষ্টেশন ক্লাব রূপ লাভ লিমিটেড কোম্পানীতে। ১৩৩ বছরের ইতিহাসে গৌরবের এক নাম ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব’।
আজকাল শুদ্ধি অভিযানে দেখাযায় রাজধানী ঢাকার কয়েকটি ‘বাণিজ্যিক’ ক্লাবে যেভাবে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়, সুন্দরী রমণীদের আনাগোনা ও অস্ত্রবাজদের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির বিষয়টি স্বাভাবাকি। আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানের পর অনেকে বলেছেন, এসব ক্লাবের আয় দিয়ে তারা খেলোয়ার তৈরি করতেন। ক্লাব বন্ধ হয়ে গেলে খেলোয়ার তৈরি হবে না। অথচ গণমাধ্যমের খবরে এসেছে এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমেই শ’ শ’ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন বিদেশেও। অভিযানকৃত ওই ক্লাবগুলোকে বাণিজ্যিক বলার অর্থ হলো এদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল নিজেদের আখের গোছানো। এই ক্লাবগুলোর সামাজিক কোনো দায়বোধও নেই এবং কখনো ছিল না বলেও মনে করেন সচেতন মহল।
ঐতিহ্যবাহী সিলেট স্টেশন ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৮৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করেছে তখনই তার প্রতিষ্ঠা। বিশিষ্ট সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার-এর ‘সামাজিক ক্লাব: অতীত ও বর্তমান’ লেখা পর্যালোচনা করলে জানা যায়, বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ববঙ্গ) প্রথম ক্লাব গড়ে বরিশালে, ১৮৬৪ সালে। তখন বাখেরগঞ্জ জেলার সদর কার্যালয় ছিল বরিশালে। এসবের ক্ষেত্রে মূলত ইংরেজদেরই ভূমিকা ছিল। তারা যেখানেই গেছে সেখানেই ক্লাব গড়েছে। ভারতবর্ষে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলেই প্রথম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম ‘ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাব’। এর গোড়াপত্তন হয় ১৭৯৩ সালে। এরপর কলকাতায় একে একে যে ক্লাবগুলো গড়ে উঠে সেগুলো হলো- ব্যাঙ্গল ক্লাব (১৮২৯), রয়েল রোয়িং ক্লাব (১৯২৯), ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব (১৯৫৮), ক্যালকাটা পলো ক্লাব (১৮৬২), স্ট্যাটারডে ক্লাব (১৮৭৫), রয়েল ক্যালকাটা টারফ ক্লাব (১৮৮৮), টলিগঞ্জ ক্লাব (১৮৯৫০) ও ক্যালকাটা ক্লাব (১৯০৭)। এরপর শুধুমাত্র ইংরেজদের ব্যবহারের জন্য ঐতিহ্যবাহী সিলেট স্টেশন ক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন শহরে আরও কয়েকটি ক্লাব গড়ে ওঠে।
আমরা যদি তাকাই সিলেট স্টেশন ক্লাবের দিকে, দেখা যাবে সেই ইংরেজরাই তার প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তী সময়ে এর দায়িত্ব নেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই। এ ক্লাবের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত এ এস এম আব্দুল মুবিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত তোফায়েল করিম হায়দার, ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান সাফওয়ান চৌধুরী, মৌলভীবাজার সাতগাঁও টি গার্ডেন-এর ম্যানেজিং পার্টনার আরদাশির কবির।
ক্লাব কর্তাদের সাথে আলোচনা করলে জানা যায়, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাণিজ্যেক যেসব ক্লাব গড়ে উঠেছে সেখানে অবাধে সাধারণ মানুষের পদচারণা রয়েছে। তবে ঢাকা ক্লাব বা সিলেট স্টেশন ক্লাবের মতো যেসব ক্লাব আছে সেখানে তাদের সদস্যদের বাইরে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ অতিথি ও বিদেশি পাসপোর্টধারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই বলেও জানা তারা।
এসব ক্লাবের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট। মূলত সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কিছুটা অবসর সময় কাটানোর জন্যই ইতিহাসের অনেক স্বাক্ষী হয়ে আছে এসব ক্লাব। ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্লাবগুলো এখনও যে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বহাল রয়েছে তা কিন্তু কম কথা নয়। আজকে এই সিলেট স্টেশন ক্লাবের ইতিহাস জানলে সেই ইংরেজদের কথাই বারবার উঠে আসে। ১৮৮৬ সালে তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই এ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা।
একসময় শুধু ইংরেজরাই ছিলেন এর সদস্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও পটপরিবর্তন। পাকিস্তানিদের বিদায়ের পর তা দখলে আসে বাংলাদেশিদের। সদস্য হতে থাকেন সরকারী কর্মকর্তা, শিল্পপতি, চা-কর সাংবাদিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনজীবিসহ সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা। সেই ১৩৩ বছরের পুরনো ক্লাবের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন প্রতিনিধিত্বশালীরা সিলেট ষ্টেশন ক্লাবের। টাকা হলেই এ ক্লাবের সদস্য হওয়া যাবে-এমন ভাবনা ভুল। আবার সদস্য হলে নিয়ম-নীতি না মানলে যে ক্লাব ঘর ব্যবহার করতে পারবে এমন ধারনাটাও ভুল বললেন ষ্টেশন ক্লাবের কর্তরা। তারা জানান ক্লাবের নিয়ম-নীতি না মানার কারণে ইতি পূর্বেই অনেকের বিরুদ্ধেই নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা।
সম্প্রতি এ ক্লাবে গেলে স্বাগত জানান ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট ই. ইউ. শহিদুল ইসলাম। তিনি সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সরকারী কৌঁসুলীও। ক্লাবের ভেতরের বিভিন্ন কক্ষ দেখলে সত্যিই চমকে ওঠার মতো। ক্লাব ভবনে প্রবেশের সময়ই চোঁখে পড়ে জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জীবিত ও মৃত অনেক বিশিষ্টজনের ছবি। যাঁরা এ ক্লাবেরই সদস্য। এমন কয়েকজন হলেন সাবেক স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইফতেখার হোসেন শামীম সহ অনেকেরই। এরপর ক্লাবের হলরুম, ডাইনিং, সুইমিং পুল, টেবিল টেনিস, ক্যারাম, দাবা, ব্যডমিন্টন, ভলিবলসহ নানা খেলাধুলার আকর্ষণীয়তা দেখে সত্যিই মুগ্ধহওয়ার মতো। এক মনোরম পরিবেশ বলতে যা বুঝায় তার ঠিকানা সিলেট ষ্টেশন ক্লাব।
নিখুঁত কারুকাজ ও সৌন্দর্যে ভরপুর এ ক্লাবে শুধু সদস্যদের চিত্তবিনোদনই নয়, বাইরের সামাজিক অনেক উৎসবও হয়ে থাকে। ক্লাবটি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে সামাজিক কর্মকান্ড, বিয়ে, জন্মদিন বা অন্যান্য অনুষ্ঠানও হয় সেখানে। সরকারী দিবসেও তারা পালন করে নানা কর্মসূচিত।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে প্রেসিডেন্ট ই. ইউ. শহিদুল ইসলাম জানান, সিলেট স্টেশন ক্লাবের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪২৫ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪৫ জন। ক্লাবের সদস্যদের ফি ও অন্যান্য খাতে যে আয় হয় তা থেকে সংশ্লিষ্টদের ভেতন-ভাতাদি দেওয়া ছাড়াও দু:স্থ ও সামাজিক কর্মকা-ে দেয়া হয় নগদ অর্থ।
শুধু তাই নয়, প্রতিটি জাতীয় দিবস যেমন বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননাও দিচ্ছেন। এ ক্লাবের ব্যবস্থাপক পরাগ কান্তি দেব বলেন, দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়েছেন, অথচ বর্তমানে অসহায় দিনযাপন করছেন এমন কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে মাঝেমধ্যে আর্থিক সহায়তাও করা হয়। যেহেতু এটি কোনো বাণিজ্যিক ক্লাব নয়, সেহেতু সমাজে তার একটি দায়বদ্ধতা থেকে যায়। আর তা থেকে সিলেট স্টেশন ক্লাবও পিছ পা নয়। কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো সমাজে মাথা উঁচু করে যে ক্লাবের পরিচয় দেয়া যায় সেটি হচ্ছে সিলেট ষ্টেশন ক্লাব।
সমাজ কল্যাণ সংস্থা থেকে নিবন্ধিত সিলেট ষ্টেশন ক্লাব মানবিক ও সামাজিক সব উদ্দ্যেগের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করে চলছে। যে ক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা, বিচারপতি থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনার ম্যান পাওয়াররা সাম্প্রিত্ত রয়েছে। সিলেটের সামাজিক অঙ্গনে রয়েছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহ্য।
বর্তমান সময়ে ঢাকার অলি-গলিতে গড়ে ওঠা ক্লাব গুলো ষ্টেশন ক্লাবের মতো সুনামধন্য ক্লাবের ঐতিহ্য ধ্বংস করে দিচ্ছে সামাজিক অঙ্গনে। ক্লাব পাড়া মানে ক্যাসিনো আর অসামাজিকতা এমন ধারণার সৃষ্টি করছে আজকালের ক্যাসিনো স¤্রাটেরা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আগেকার সময়ে ক্লাব সংগঠনে কাজ করতো যুবকরা আর অর্থের যোগান দিতো অভিবাকরা। অতিথি করা হতো অনুষ্ঠান করে সুনামধন্য ধণাঢ্য ব্যক্তিদের।
সিলেট ষ্টেশন ক্লাব দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত ও প্রাচীন ক্লাবগুলোর মধ্যে একটি। দেশের বরণ্য ক্লাব গুলোর মধ্যে প্রথম সারীর ক্লাবের মধ্যেই যার অবস্থান বললে চলে। এ ক্লাবের ঐতিহ্য ও সুনাম দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। শুধু বিনোদনই নয় আর্ত্মসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ ক্লাবের ভূমিকা প্রশংসার দাবী রাখে। সহায়তা করা হয় ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী অসহায় দুস্থদেরও।
ক্লাব সংগঠনের সেই শিষ্টাচার আজকের প্রজন্মের কাছে ক্যাসিনো নামে খ্যাত। কিন্তু এদের মধ্যেও দেশের ব্যতিক্রমী নীতি-নৈতিকতা নিয়ম-কানুনের মধ্যে আবদ্ধ ক্লাব গুলোর মধ্যে একটি সিলেট ষ্টেশন ক্লাব।
এখন ক্লাব নামধারী স্থানে আবিস্কার হয়েছে অপরাধ জগতের আস্তানা। আইনশৃংখলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় এসব অপরাধ পরিচালনা হয়ে আসলেও ইদানিং এর শুদ্ধি অভিযানে বেরিয়ে আসলো ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো পরিচালনার ফিরিস্তি। কোটি কোটি টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক নেতারা। উদ্ধার হয়েছে অস্ত্র, মাদকসহ আরও অনেককিছু। এসব দেখে সঙ্গত কারণেই ক্লাবের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরূপ ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছে ক্লাব মানেই জুয়া, ক্লাব মানেই অপরাধীদের আস্তানা। কিন্তু না, তাদের এ ধারণা পরিবর্তনের জন্য সিলেট ষ্টেশন ক্লাবই যতেষ্ট। সরেজমিনে সিলেট ষ্টেশন ক্লাবে দৈনিক সংবাদ এর বিশেষ প্রতিনিধি আকাশ চৌধুরী, অপরাধ বিচিত্রার সিলেট ব্যুারো চীফ নুরে আলম খোকন, সাংবাদিক ইদ্রিছ সহ মিডিয়ার একটি টিমকে নিয়ে আমি অনুসন্ধানে গেলে দেখা যায় প্রাণবন্দ এই পরিবেশ।
এসব ক্লাবের নেতৃত্বে থাকা সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেকেই স¤্রাটের ক্যাসিনোর কালো ধোয়ায় আজ প্রশ্নবৃদ্ধ। কিন্তু তার জন্য কি বাদ পড়ে যাবে দেশের সভ্যসমাজের ঐক্যের বন্ধন ক্লাব সংগঠন? ২০০৬ সালে সিলেট ষ্টেশন ক্লাব রূপ লাভ লিমিটেড কোম্পানীতে। ১৩৩ বছরের ইতিহাসে গৌরবের এক নাম ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব’।
আজকাল শুদ্ধি অভিযানে দেখাযায় রাজধানী ঢাকার কয়েকটি ‘বাণিজ্যিক’ ক্লাবে যেভাবে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়, সুন্দরী রমণীদের আনাগোনা ও অস্ত্রবাজদের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির বিষয়টি স্বাভাবাকি। আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানের পর অনেকে বলেছেন, এসব ক্লাবের আয় দিয়ে তারা খেলোয়ার তৈরি করতেন। ক্লাব বন্ধ হয়ে গেলে খেলোয়ার তৈরি হবে না। অথচ গণমাধ্যমের খবরে এসেছে এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমেই শ’ শ’ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন বিদেশেও। অভিযানকৃত ওই ক্লাবগুলোকে বাণিজ্যিক বলার অর্থ হলো এদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল নিজেদের আখের গোছানো। এই ক্লাবগুলোর সামাজিক কোনো দায়বোধও নেই এবং কখনো ছিল না বলেও মনে করেন সচেতন মহল।
ঐতিহ্যবাহী সিলেট স্টেশন ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৮৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করেছে তখনই তার প্রতিষ্ঠা। বিশিষ্ট সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার-এর ‘সামাজিক ক্লাব: অতীত ও বর্তমান’ লেখা পর্যালোচনা করলে জানা যায়, বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ববঙ্গ) প্রথম ক্লাব গড়ে বরিশালে, ১৮৬৪ সালে। তখন বাখেরগঞ্জ জেলার সদর কার্যালয় ছিল বরিশালে। এসবের ক্ষেত্রে মূলত ইংরেজদেরই ভূমিকা ছিল। তারা যেখানেই গেছে সেখানেই ক্লাব গড়েছে। ভারতবর্ষে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলেই প্রথম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম ‘ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাব’। এর গোড়াপত্তন হয় ১৭৯৩ সালে। এরপর কলকাতায় একে একে যে ক্লাবগুলো গড়ে উঠে সেগুলো হলো- ব্যাঙ্গল ক্লাব (১৮২৯), রয়েল রোয়িং ক্লাব (১৯২৯), ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব (১৯৫৮), ক্যালকাটা পলো ক্লাব (১৮৬২), স্ট্যাটারডে ক্লাব (১৮৭৫), রয়েল ক্যালকাটা টারফ ক্লাব (১৮৮৮), টলিগঞ্জ ক্লাব (১৮৯৫০) ও ক্যালকাটা ক্লাব (১৯০৭)। এরপর শুধুমাত্র ইংরেজদের ব্যবহারের জন্য ঐতিহ্যবাহী সিলেট স্টেশন ক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন শহরে আরও কয়েকটি ক্লাব গড়ে ওঠে।
আমরা যদি তাকাই সিলেট স্টেশন ক্লাবের দিকে, দেখা যাবে সেই ইংরেজরাই তার প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তী সময়ে এর দায়িত্ব নেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই। এ ক্লাবের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত এ এস এম আব্দুল মুবিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত তোফায়েল করিম হায়দার, ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান সাফওয়ান চৌধুরী, মৌলভীবাজার সাতগাঁও টি গার্ডেন-এর ম্যানেজিং পার্টনার আরদাশির কবির।
ক্লাব কর্তাদের সাথে আলোচনা করলে জানা যায়, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাণিজ্যেক যেসব ক্লাব গড়ে উঠেছে সেখানে অবাধে সাধারণ মানুষের পদচারণা রয়েছে। তবে ঢাকা ক্লাব বা সিলেট স্টেশন ক্লাবের মতো যেসব ক্লাব আছে সেখানে তাদের সদস্যদের বাইরে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ অতিথি ও বিদেশি পাসপোর্টধারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই বলেও জানা তারা।
এসব ক্লাবের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট। মূলত সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কিছুটা অবসর সময় কাটানোর জন্যই ইতিহাসের অনেক স্বাক্ষী হয়ে আছে এসব ক্লাব। ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্লাবগুলো এখনও যে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বহাল রয়েছে তা কিন্তু কম কথা নয়। আজকে এই সিলেট স্টেশন ক্লাবের ইতিহাস জানলে সেই ইংরেজদের কথাই বারবার উঠে আসে। ১৮৮৬ সালে তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই এ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা।
একসময় শুধু ইংরেজরাই ছিলেন এর সদস্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও পটপরিবর্তন। পাকিস্তানিদের বিদায়ের পর তা দখলে আসে বাংলাদেশিদের। সদস্য হতে থাকেন সরকারী কর্মকর্তা, শিল্পপতি, চা-কর সাংবাদিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনজীবিসহ সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা। সেই ১৩৩ বছরের পুরনো ক্লাবের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন প্রতিনিধিত্বশালীরা সিলেট ষ্টেশন ক্লাবের। টাকা হলেই এ ক্লাবের সদস্য হওয়া যাবে-এমন ভাবনা ভুল। আবার সদস্য হলে নিয়ম-নীতি না মানলে যে ক্লাব ঘর ব্যবহার করতে পারবে এমন ধারনাটাও ভুল বললেন ষ্টেশন ক্লাবের কর্তরা। তারা জানান ক্লাবের নিয়ম-নীতি না মানার কারণে ইতি পূর্বেই অনেকের বিরুদ্ধেই নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা।
সম্প্রতি এ ক্লাবে গেলে স্বাগত জানান ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট ই. ইউ. শহিদুল ইসলাম। তিনি সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সরকারী কৌঁসুলীও। ক্লাবের ভেতরের বিভিন্ন কক্ষ দেখলে সত্যিই চমকে ওঠার মতো। ক্লাব ভবনে প্রবেশের সময়ই চোঁখে পড়ে জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জীবিত ও মৃত অনেক বিশিষ্টজনের ছবি। যাঁরা এ ক্লাবেরই সদস্য। এমন কয়েকজন হলেন সাবেক স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইফতেখার হোসেন শামীম সহ অনেকেরই। এরপর ক্লাবের হলরুম, ডাইনিং, সুইমিং পুল, টেবিল টেনিস, ক্যারাম, দাবা, ব্যডমিন্টন, ভলিবলসহ নানা খেলাধুলার আকর্ষণীয়তা দেখে সত্যিই মুগ্ধহওয়ার মতো। এক মনোরম পরিবেশ বলতে যা বুঝায় তার ঠিকানা সিলেট ষ্টেশন ক্লাব।
নিখুঁত কারুকাজ ও সৌন্দর্যে ভরপুর এ ক্লাবে শুধু সদস্যদের চিত্তবিনোদনই নয়, বাইরের সামাজিক অনেক উৎসবও হয়ে থাকে। ক্লাবটি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে সামাজিক কর্মকান্ড, বিয়ে, জন্মদিন বা অন্যান্য অনুষ্ঠানও হয় সেখানে। সরকারী দিবসেও তারা পালন করে নানা কর্মসূচিত।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে প্রেসিডেন্ট ই. ইউ. শহিদুল ইসলাম জানান, সিলেট স্টেশন ক্লাবের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪২৫ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪৫ জন। ক্লাবের সদস্যদের ফি ও অন্যান্য খাতে যে আয় হয় তা থেকে সংশ্লিষ্টদের ভেতন-ভাতাদি দেওয়া ছাড়াও দু:স্থ ও সামাজিক কর্মকা-ে দেয়া হয় নগদ অর্থ।
শুধু তাই নয়, প্রতিটি জাতীয় দিবস যেমন বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননাও দিচ্ছেন। এ ক্লাবের ব্যবস্থাপক পরাগ কান্তি দেব বলেন, দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়েছেন, অথচ বর্তমানে অসহায় দিনযাপন করছেন এমন কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে মাঝেমধ্যে আর্থিক সহায়তাও করা হয়। যেহেতু এটি কোনো বাণিজ্যিক ক্লাব নয়, সেহেতু সমাজে তার একটি দায়বদ্ধতা থেকে যায়। আর তা থেকে সিলেট স্টেশন ক্লাবও পিছ পা নয়। কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো সমাজে মাথা উঁচু করে যে ক্লাবের পরিচয় দেয়া যায় সেটি হচ্ছে সিলেট ষ্টেশন ক্লাব।