মৌলভীবাজারে মেয়েদের আতংক ‘ইভটিজিং স্ট্যান্ড’


বিশেষ প্রতিনিধিঃ চোখ টিপুনি,গা ঘেষে দাঁড়ানো কিংবা কায়দা কৌশলে শরীর ছোঁয়া। আর নানা অঙ্গ ভঙ্গি আর অশ্লীল কথাবার্তায় স্কুল কলেজের মেয়েদের উত্ত্যেক্ত করা। ওখানে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমান গাড়ি চালকদের যেন এটিই অন্যতম আনন্দের কাজ। স্থানটি যেন ইভটিজিংয়ের স্ট্যান্ড। তাই মেয়েরা এই স্থান পাড়ি দেন চরম আতংকে। মৌলভীবাজার চাঁদনীঘাট গাড়ি স্ট্যান্ড। যৌন হয়রানীর শিকার মেয়েদের কাছে ওখানকার পরিচিতি এখন এমনই। অভিযুক্ত ওই স্থানটি নিয়ে মেয়েদের অভিযোগের অন্ত নেই। স্কুল কলেজের ছাত্রীরা প্রতিদিনই ওখানে যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া সময় ওদের পাতানো ফাঁদে পড়ছেন তারা।
প্রকাশ্যে দিন দুপুরে চলে ওদের এমন বখাটেপনা। কিন্তু এমন দৃশ্য দেখেও কেউ প্রতিবাদী হয়না। বরং উল্টো অনেকেই তা দেখেও কৌশলে না দেখার ভান করেন। এমন অভিযোগ ভূগতভোগীদের। আর লোকলজ্জ্বার ভয়ে নিরবে নিভৃত্যে প্রতিদিনই তা সহ্য করেন ওই সকল শিক্ষার্থীরা। পরিবার সহপাঠী কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবস্থানেই অভিযোগ দিয়ে মিলছেনা প্রতিকার। কিছুতেই বন্ধ হয়না এই উদ্ভুট অসহ্য যন্ত্রণার। সম্প্রতি অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছে এমন বখাটেপনা। নব্য আর্বিভূত অপকর্ম বয়ে চলা স্থানটিতে এখন চরম অসভ্যতা ও বখাটেপনায় অতিষ্ট ছাত্রীরা।
তাই নিজেদের কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের ফেসবুক আইডিতে এই নীরবে সরব বখাটেপনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মৌলভীবাজার শহরের প্রবেশ দ্বার চাঁদনীঘাট এলাকা। স্থানটি জেলা শহরের সেতুবন্ধন হিসেবেই পরিচিত। কারন জেলার ৭টি মধ্যে ৪টি উপজেলার মানুষের জেলা শহরের সাথে পরিবহনে যোগাযোগ ওখান থেকেই। বাস,মিনিবাস,মাইক্রোবাস, আর সিএনজি চালিত অটো রিকশা (সিএনজি) ও টমটম এর স্ট্যান্ড ওখানেই। মৌলভীবাজার কুলাউড়া সড়কের উপরেই তাদের স্ট্যান্ড। মনু ব্রিজের (চাঁদনীঘাট ব্রিজ)উত্তর পাশ থেকে শুরু হয়ে প্রায় অর্ধকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবৈধ এই গাড়ি স্ট্যান্ড। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর জন্য অপেক্ষমান ছোট বড় গাড়িগুলোর চালক ও সহযোগীরাই স্কুল কলেজে আসা যাওয়ার সময় মেয়েদের নানা ভাবে উত্ত্যেক্ত করে।
সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও টমটমের চালকরা এ কাজে এগিয়ে থাকার অভিযোগ ভূগতভোগীদের। কুলাউড়া,জুড়ী,বড়লেখা ও রাজনগরের মানুষের নির্দিষ্ট গন্তব্যে আসা যাওয়া ওখান থেকে। জেলার স্বনাম ধন্য ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ, সরকারী মহিলা কলেজ, শাহমোস্তফা কলেজ, কাশিনাথ আলাউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ, ইম্পিরিয়াল কলেজ, হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আলী আমজদ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, শাহ হেলাল উচ্চ বিদ্যালয় ও মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদ্রাসা। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রতিনিয়ত কয়েক হাজার ছাত্রী পাঠগ্রহণ করতে আসেন। তাদের আসা যাওয়ার সময় চাঁদনীঘাট গাড়ি স্ট্যান্ড এলাকায় শিকার হতে হয় চরম বখাটে পনার। ওদের দ্বারা লাঞ্চিত হয়ে মানুষিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়। এখন এস্থানসহ আরো কয়েকটি স্থান স্কুল কলেজ পড়–য়া মেয়েদের জন্য চরম আতংকের। ওই স্থানগুলো তারা ভয় আর অজানা শঙ্কায় কোন রকম পাড়ি দেন। তাদের অভিযোগনুযায়ী অভিযুক্ত শহরের এই ইভটিজিং স্পট গুলো হল পৌরসভা ও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের পূর্বপাশের গাড়ি স্ট্যান্ড, শিল্পকলা একাডেমির সামনের গাড়ি স্ট্যান্ড, সমশেরনগর রোডের সিএনজি গাড়ি স্ট্যান্ড, কুসুমভাগ চৌমহনার পশ্চিম পাশের গাড়ি স্ট্যান্ড। ওই স্থান গুলোর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন অনেক গাড়ি চালক ও তাদের সহযোগীদের এমন অশ্লিলতা,বখাটেপনা ও ইভটিজিংয়ের কারনে আমাদের এলাকার র্দূনাম হচ্ছে। তাদের এমন যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ট। আমরা ওই বখাটেপনা বন্ধ করতে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাচ্ছি।
সম্প্রতি সরকারী কলেজ ও মহিলা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী এবিষয়ে তাদের ফেসবুক আইডিতে ওই স্থানগুলোতে তাদের চরম অসহায়ত্বের বিষয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এদের মধ্যে জামি রহমান ও স্টুডেন্ট প্লাট ফর্ম অব মৌলভীবাজার নামক ফেসবুক আইডির লিখাটি হুবুহু তুলে ধরা হল।
মৌলভীবাজার চাঁদনীঘাট বহু পরিচিত একটা জায়গার নাম। কুলাউড়া,রাজনগর, মুন্সিবাজার এলাকার লোকজন এই রোডে মৌলভীবাজার শহরে আসতে হলে তারা অবশ্যই চাঁদনীঘাট হয়ে আসতে হয়। চাঁদনীঘাট বাসস্ট্যান্ড,সিএনজি স্ট্যান্ড মৌলভীবাজারের অনেক প্রাচীন ও পুরাতন। জেলা শহরে সরকারী-বেসরকারী নামি দামি স্কুল কলেজ থাকায় রাজনগরের আশপাশের অনেকেই সেখানে লেখাপড়া করে থাকেন। শত শত ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিদিন চাঁদনীঘাট হয়ে জেলা শহরে আসা যাওয়া করেন। তখন তাদের প্রতিনিয়ত সিএনজি ড্রাইভার দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। লাঞ্চিত হতে হনমেয়েরা। এখন আতঙ্কের নাম চাঁদনীঘাট সিএনজি স্ট্যান্ড।
মৌলভীবাজার মহিলা কলেজের এক ছাত্রী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার প্রতিদিন লাঞ্চিত হওয়ার বর্ণনা এভাবেই দেন। আমি ও আমার সহপাঠীরা মহিলা কলেজে পড়ি। আমরা রাজনগর থেকে প্রতিদিন কলেজে আসি। সে ক্ষেত্রে চাঁদনীঘাট ব্রিজ হয়েই আমাদের আসতে হয়। আমরা বাড়ি থেকে যখন চাঁদনীঘাট এসে সিএনজি করে নামি। তখন অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকে সেখানে থাকা ড্রাইবারদের কাছ থেকে ইভটিজিং-অশ্লিল কথাবার্তার শিকার হতে হয়। অনেক ড্রাইবার আমাদের শরীরের সাথে ঘেষাঘেষি করার চেষ্ঠা করেন। সেখানের কিছু বখাটে যুবকরা এভাবেই আমাদের সাথে খারাপ আচরন করে। কিছু ড্রাইবার গাড়ি ভাড়া দিতে গেলে বলে আপনার ভাড়া লাগবেনা। আপনার ফোন নাম্বার দেন। আপনাকে আমার ভালো লাগে। অনেক সময় চাঁদনীঘাট হয়ে হেঁেট কলেজে যেতে হয়। তখন মাঝে মধ্যে আরো বড় বড় পরিস্থিতির শিকার হতে হয়।
পৌরসভার পাশে যে কার স্ট্যান্ড সেখানের ছেলেরাও আমাদের সাথে একই আচরন করে। শুধু আমাদের কলেজ পড়–য়া সব মেয়েদেরই একি অভিযোগ। সামনে আমাদের পরীক্ষার সময় (২টা-৫টা) সে ক্ষেত্রে আমাদের বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমাদের নিরাপত্তা আছে কি? মেয়ে বলে কি আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই? আমরাতো বোরখা পরে বের হই। তা হলে কেন আমাদের প্রতিদিন ভয়ের উপর যাত্রা করতে হয়। আমরা সামাজিক,শারিরীক,মানুষিক অত্যাচারে আছি। আমাদের সাহায্য করুন। মুরব্বিরা দেখেন কিন্তু তারা এড়িয়ে যান। আমরা কি পড়াশোনা বন্ধ করে দিব ? উত্তরটা আপনাদের কাছে। ভূগতভোগী অনেকেই এভাবে ফেসবুকে লিখে তাদের এই মানুষিক যন্ত্রণার কথা তুলে ধরছেন।
চাঁদনীঘাট এলাকার সমাজকর্মী আব্দুল মুহিত দিপু জানান হঠাৎ করে এই স্থানটিতে ইভটিজিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। সম্প্রতি কয়েকজনকে হাতে নাতে ধরে উত্তম মধ্যম দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন আমার স্থানীয় ভাবে একটি প্রতিরোধ কমিটি করেছি। প্রতিটি দোকানে আমাদের ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। কেউ ইভটিজিংয়ের শিকার হলে আমাদের জানালে আমরা অবশ্যই তা প্রতিহত করব। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন ওই বখাটেদের কারনে আমাদের এলাকার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
জেলা যৌন হয়রানী নির্মূল নেটওর্য়াক মৌলভীবাজার এর আহবায়ক ও হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম জানান যারা এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা আমাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমাদেরও ব্যবস্থা নিতে সুবিদা হয়। অবশ্য যারা অভিযোগ দিবে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হবে। ইভটিজিং প্রতিরোধে সকলের সচেতনতার প্রয়োজন।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল এবিষয়ে জানান কেউ এবিষয়ে অভিযোগ করেনি। তারপরও যে হেতু স্থানগুলোতে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ উঠছে তাই এখন থেকে এই স্থানগুলোর প্রতি আমাদের আরো বাড়তি নজরদারি থাকবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post