এই দুর্ঘটনার দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারবেনা রেলওয়ে কতৃপক্ষ


এস এইচ সৈকতঃ সিলেট - আখাউড়া রোডের স্বরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে গতকাল ২৩ জুন রাত প্রায় ১২ টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায়। এর আগেও প্রায় সময় এই রোডে ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও কখনো এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে নি। ট্রেনের ৬ টি বগি রেললাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এর মধ্যে ১ টি পানিতে পড়ে যায়, আর ৩ টি খালের পাশে দুমড়েমুচড়ে পড়ে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫ জন নিহত এবং ৬৭ জন লোক আহত হয়েছেন বলে ফায়ারসার্ভিসের একটি সূত্র জানিয়েছে।

প্রবাসে থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় হতাহতের খবর নিয়েছি। নির্ঘুম রাত কেটে ভোরে আবার অফিসে আসতে হয়েছে। যেদিকে তাকাই চোখের সামনে ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ। ট্রেনের নিচে পিষ্ট হওয়া মহিলার ছবি। নিজ উপজেলায় এতো বড় ট্রাজেডি!

ওই রাতে জেলা ও উপজেলার সিনিয়র কয়েকজন সাংবাদিক ও এলাকার (ঘটনাস্থলের) অনেকের সাথেই কথা হয়। কেউ কেউ ছিলেন উদ্ধার কাজে ব্যাস্ত, আবার অনেকই ব্যাস্তার মাঝেও দিয়েছেন অনেক ইনফরমেশন। আর তাদের ভাষ্যমতে নিহতের সংখ্যা এতো কম না, অনেকগুণ বেশি হবে। কিন্তু পুলিশ গতকাল রাতে বলছে সাত জন, আবার আজ সকাল থেকে বলছে ৫ জনের কথা। এলাকাবাসীর কথামতো, তাহলে কোথায় গেলো বাকি লাশ গুলো? বলা হয়েছিল সাধারণের চেয়ে আড়াই গুন বেশি যাত্রী ছিলেন দুর্ঘটনায় কবলিত বগিগুলোতে। তাহলে ৬ টি বগিতে কিভাবে মাত্র ৬৭ জন লোক আহত হলেন? দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ৪টি বগিতে মানুষ থাকার কথা কমপক্ষে সাড়ে ৪ শতাধিক। এমন মারাত্মক দূর্ঘটনায় সাড়ে ৪ শতাধিক যাত্রীর মধ্যে মাত্র ৬৭ জন আহত হবেন সেটাতো কল্পনাই করা যায় না। বাকি যাত্রীদের অবস্থা কি? কেনো সঠিক হিসেব দেয়া হচ্ছে না? এমন অনেক প্রশ্নই থেকে যায় ফায়ারসার্ভিস ও পুলিশের বিরুদ্ধে।

ফায়ারসার্ভিসের উর্ধতন এক কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত লিস্ট অনুযায়ী নিহত ৫ জনের পরিচয় হচ্ছে, বরিশালের আব্দুল খালেকের মেয়ে আয়েশা আক্তার (২৮), সিরাজগঞ্জের আঃ রাজন'র ছেলে অলিউর রহমান (৭৫), সেলিম (২৫) বাড়ি রাজশাহীতে, কুলাউড়ার আঃ জাহিদের মেয়ে রোনা বেগম (৩৫) ও কিশোরগঞ্জের রুহুল আমিনের ছেলে আনিস (২০)।

কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গেছেন ওই রাতে কুলাউড়া হাসপাতালে ৪টি লাশের পরিচয় সনাক্ত করা হয়েছিলো যাদের নাম ফায়ারসার্ভিসের এই লিস্টেই নেই। তারা হলেন, সিলেট নার্সিং কলেজের ছাত্রী সিলেট দক্ষিণ সুরমা এলাকার আব্দুল বারি'র মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০), বাগেরহাট জেলার সানজিদা আক্তার (২০), হবিগঞ্জের বাহুবল এলাকার নূর হোসেনের ছেলে কাওসার (২৬), কুলাউড়া আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল বারী'র স্ত্রী মনোয়ারা পারভিন (৪৫)।

এখন সবার মাঝে একটাই প্রশ্ন নিহত ও আহতদের সঠিক হিসাব দেয়া হচ্ছে না কেনো? এ নিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমে সরব এলাকার যুবসমাজ। যারা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছানোর আগে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। এবং তারা দাবি করেন নিজ হাতে অনেকগুলো লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি ওই ট্রেনে থাকা অনেক যাত্রীও ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন পুলিশ দেখেছে ৫ টি লাশ আর আমরা দেখেছি লাশের মিছিল।

আমি কুলাউড়ায় থাকাকালীন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সাথে জড়িত ছিলাম। ২০১৪-১৫ সাল বা তার আগে থেকে আমি এবং আমার সহকর্মী সাংবাদিকরা মিলে অনেক নিউজ করেছিলাম এই রেল লাইন নিয়ে। কুলাউড়ায় রেল লাইনের ক্লিপ চুরির হিড়িক, রেল লাইনে ক্লিপ আছে নাট বল্টু নেই, ব্রিজের উপর বাঁশ দিয়ে স্লিপার মেরামত, কুলাউড়ায় উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা সহ অনেক অনেক নিউজ আসে দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইনে। কিন্তু কতৃপক্ষের উদাসীনতায় কোনো কাজ হয়নি এই লাইনে। কোনো গুরুত্ব দেননি তারা এই সকল নিউজের। রেলের জন্য এতো টাকা বাজেট আসে, কিন্তু কোনো কাজ হয় না এই লাইনের। আর এতো দিনের এই সন্দেহ আজ বাস্তবে রূপ নিল। তাই বলা যায় কতৃপক্ষের এমন উদাসিনতায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এর সম্পূর্ণ দায় নিতে হবে তাদেরকে।

এরই মধ্যে তাদের উপর থেকে দায়ভার এড়াতে রেল মন্ত্রী প্রথমে বলেছেন, অধিক যাত্রী হওয়ার কারনে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। পরে আবার উনার বক্তব্য পরিবর্তন করে তিনি বলেন, লাইন পরিবর্তন করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

কিন্তু ব্রিজের উপর যে লাইন পরিবর্তন হয় সেটা আজ প্রথম শুনলাম। তাও আবার এক লাইনের রোডে। আর একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়ে এমন দায়িত্বহীন কথা বার্তা বলা একমাত্র আমাদের দেশেই সম্ভব। উন্নত দেশ হলে এতোক্ষণে তিনি পদত্যাগ করতেন।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে জানতে পারলাম দূর্ঘটনার পর রেলসচিব, সংসদ সদস্যসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এমনকি আগামী ২৬ জুন বুধবার সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ভয়াবহ ট্রেন দূর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন। তাঁরা এখন কেন লোক দেখানো পরিদর্শনে যাবেন? তাদের বা সরকারের সংশ্লিষ্ট  মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা আমাদের পূর্বের নিউজ গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেল রুট পরিদশর্ন করে সংস্কার কাজ করলে আজ হয়তো এতো বড় রেল দূর্ঘটনার কবলে পড়ে মানুষের মৃত্যু হত না। আসলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার ব্যার্থ? নাকি দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তার কারনে যথাযত উন্নয়ন সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না?

লেখকঃ এস এইচ সৈকত
প্রবাসী সাংবাদিক
ইমেলঃ Soykotpress11@gmail.com

Post a Comment

Previous Post Next Post