ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘিরে সক্রিয় প্রতারক চক্র


নিউজ ডেস্কঃ এমনিতেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছে এক লাখের বেশি বাংলাদেশী। তাদের ফিরিয়ে আনার চাপ রয়েছে দেশের ওপর। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইভেন্ট ঘিরে তৎপর হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্র। গত বছর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের পর এবার ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘিরেও বলয় তৈরি করেছে চক্রটি। ইউরোপে অভিবাসনের প্রলোভন দেখিয়ে টিকিট বিক্রি করছে তারা। বিষয়টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নজরে এলে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে সংস্থাটি। তার পরও বন্ধ হয়নি একই প্রলোভনে টিকিট বিক্রি।

জানা গেছে, ইংল্যান্ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখতে অনলাইনে টিকিট কেনার সময় ছিল গত বছরের ১৩ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশী অনলাইনে টিকিট কেটেছে। সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় টিকিট বিক্রি হয়েছে। এসব টিকিট কেনা ব্যক্তিদের টার্গেট করছে চক্রটি। ‘খেলার টিকিট দিলেই ইউকে ভিসার সম্ভাবনা’ এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশকিছু ট্রাভেল এজেন্সি আটঘাট বেঁধে নেমেছে। জোগাড় করছে অভিবাসনপ্রত্যাশাী তরুণদের। যুক্তরাজ্যের ভিসা করে দেয়ার কথা বলে ব্যক্তিবিশেষে ৮-১০ লাখ টাকার চুক্তিও করছে এ চক্রের সদস্যরা।

গত কয়েক দিন গুলশানের ভিসা আবেদন কেন্দ্র ভিএফএসে সরজমিনে দেখা যায় খেলা দেখতে আগ্রহীদের ভিসার আবেদন জমা দেয়ার ভিড়। উচ্চমূল্যের ভিসা ফি, ট্রাভেল এজেন্টের সার্ভিস চার্জ ও অফেরতযোগ্য ম্যাচ টিকিট নিয়ে অনেককেই ভিসার আবেদন জমা দিতে দেখা যায়। তবে ভিসা আবেদন কেন্দ্র থেকে অনেককেই হতাশা নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। রিফিউজ লেটার (ভিসা প্রত্যাখ্যানপত্র) হাতে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় তাদের।

নামিদামি ট্রাভেলস ও ট্যুর অপারেটরগুলোও বিজ্ঞাপন দিয়ে বিশ্বকাপের টিকিট বিক্রি করছে। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভিসা প্রসেসিংসহ বিভিন্ন ট্যুর প্যাকেজ ঘোষণা করছে। যদিও আইসিসির টিকিট বিক্রির অনুমোদন নেই প্রতিষ্ঠানগুলোর।

এদিকে আইসিসির লোগো ব্যবহার করে ক্রিকেট বিশ্বকাপের টিকিট ও ট্যুর প্যাকেজ বিক্রির জন্য এক্সপ্লোর হলিডেজ লিমিটেডকে গত ৭ এপ্রিল ই-মেইল পাঠায় আইসিসি। সেখানে বলা হয়, এক্সপ্লোর হলিডেজ লিমিটেড প্রচারণার মাধ্যমে বিশ্বকাপের টিকিট ও ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি করছে, যা শর্ত পরিপন্থী ও আইনবহির্ভূত। এক্সপ্লোর হলিডেজ লিমিটেড তাদের বিজ্ঞাপনে অনুমোদন ছাড়া আইসিসির লোগো ব্যবহার করছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাশাপাশি আইসিসির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এক্সপ্লোর হলিডেজ লিমিটেডকে পাঠানো চিঠিতে আরো বলা হয়, আইসিসি এ ধরনের কার্যক্রম কোনোভাবেই বরদাশত করবে না। ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করার জন্য তারা এক্সপ্লোর হলিডেজ লিমিটেডকে সতর্ক করেছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি দিয়ে ভবিষ্যতে এ থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি চেয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এক্সপ্লোর হলিডেজ লিমিটেড নয়, বিষয়টি নজরে আসায় এরই মধ্যে ২০টির বেশি বাংলাদেশী ট্রাভেলস ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে টিকিট ও ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি বন্ধ করতে বলেছে আইসিসি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এশিয়ান হলিডেজ, ডিসকভারি, আকাশবারি, কসমস হলিডেজ, হানিমুন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, আইটিএস হলিডেজ লিমিটেড, নিউ ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড লজিস্টিকস, ট্রাভেল বুকিং, শাহজালাল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস ও তালোন হলিডেজ।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ বলেন, ক্রিকেট বিশ্বকাপকে ঘিরে মানব পাচারকারী চক্রগুলো সক্রিয় হয়েছে, এটা আমরাও শুনেছি। এর সঙ্গে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান জড়িত বলে জানা গেছে। এসব কাজ বরাবরই অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সিগুলো করছে। আটাবের সদস্যভুক্ত ৩ হাজার ৩০০ ট্রাভেল এজেন্ট রয়েছে। এর বাইরেও প্রায় ১০ হাজার অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। তারাই মূলত আন্তর্জাতিক ইভেন্ট, ট্যুর প্যাকেজ এমনকি হজ-ওমরাহর সুযোগ নিয়ে মানব পাচারের চেষ্টা করে। আটাবের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের প্রবণতা কমে যাবে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও প্রলোভনে পড়ে অবৈধ পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিসি বিশ্বকাপ আয়োজনের টিকিট বিক্রি এবং অফিশিয়াল ট্রাভেল এজেন্টের স্বত্ব বিশ্বব্যাপী পেয়েছে মাত্র ১৭টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান রয়েছে একটি—ট্রিপস এন ট্যুরস লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো ট্রাভেলস ও ট্যুর এজেন্সির মাধ্যমে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট ও ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি আইসিসির নিয়মবহির্ভূত।

ট্রিপস এন ট্যুরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান হাওলাদার এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু ম্যাচের টিকিট কাটলেই যুক্তরাজ্যে খেলা দেখতে যাওয়ার ভিসা পাওয়া যায় না। ভিসা দেয়ার এখতিয়ার কেবল যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশনের। কিন্তু অনেক অসাধু চক্রই সাধারণ মানুষকে ইউরোপে অভিবাসনের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ট্যুর পাকেজ বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি ভিসা পেতে সহায়তা করার কথাও বলছে, যা একেবারেই সম্ভব নয়। ট্রিপস এন ট্যুরস কেবল বৈধ দর্শকদের কাছেই টিকিট বিক্রি করছে। আর ভিসা হলে পরবর্তী সময়ে কেউ চাইলে ট্যুর প্যাকেজ নিতে পারে।

এর আগে গত বছর রাশিয়া বিশ্বকাপ দেখতে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে যাওয়া অনেক দর্শকই ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ঢুকে পড়ে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অনেক আলোচনা হয়। এশিয়ার দেশগুলো থেকে রাশিয়ায় খেলা দেখতে গিয়ে থেকে যাওয়ার তালিকায় ছিল বাংলাদেশীরাও। অনেক বাংলাদেশী যুবক ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। সেখান থেকে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর রাশিয়ায় গ্রেফতার হন কয়েকশ বাংলাদেশী।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মানব পাচার বিভিন্নভাবে হয়। প্রলোভনে পড়ে লোকজন প্রতারিত হতে পারে। আগেভাগে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য আমরা সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলা দেখতে আগ্রহীদের ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হওয়া যাবে না। কারণ ভিসাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত হাইকমিশনের এখতিয়ার। এ ব্যাপারে কারো সঙ্গে চুক্তি না করার পরামর্শ দেন তিনি।

ইইউর পরিসংখ্যান অধিদপ্তর ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ ইউরোপে অনুপ্রবেশ করেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে ইইউতে অবৈধভাবে অবস্থান করছে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৭৫ বাংলাদেশী।

অবৈধ এসব নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনার চাপ রয়েছে। ইইউ বলেছে, যেসব নাগরিকের ইইউতে থাকার অধিকার নেই, তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে, সেসব দেশের নাগরিকদের জন্য ইইউর ভিসা সীমিত করে দেয়া হবে।

সূত্র: বণিক বার্তা

Post a Comment

Previous Post Next Post