ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধে থাকছে না ইউরোপ


অনলাইন ডেস্কঃ ইরাক যুদ্ধের সেই বিপর্যয়কর স্মৃতি এখনো ভুলে যাওয়ার মতো না। ইউরোপীয়ানদের মাথায় তা শক্তভাবে গেঁথে আছে। যে কারণে ইরানকে একটি প্রাণঘাতী যুদ্ধের উসকানি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টার বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন তারা।

ট্রাম্পের আমলে আটলান্টিক উপকূলীয় দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চললেও ওয়াশিংটনের সরাসরি বিরোধিতার একটি অস্বস্তিকর জায়গা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের

প্রাথমিকভাবে মার্কিনপন্থী ব্রিটেনও ট্রাম্প প্রশাসনের পথে হাঁটছে না। ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জোটের এক জ্যেষ্ঠ ব্রিটিশ জেনারেল ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের কোনো বাড়তি হুমকি দেখছেন না বলে দাবি করলে দেশটির কর্মকর্তারা তাতে সমর্থন জানিয়েছেন।

কিন্তু সেই যুক্তি খণ্ডন করে যুক্তরাষ্ট্রও বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। পরবর্তীতে ইউরোপীয়রা মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনাকে আরও হালকা করেছেন।

ওয়াশিংটনের সরাসরি বিরোধিতায় যেতে তারা অনিচ্ছুক। ব্রিটেন আগের বক্তব্য থেকে পিছু হটে এসেছে। দেশটি বলছে, তারা এখন আমেরিকানদের সঙ্গে একমত। আর মার্কিন হুশিয়ারির কথা উল্লেখ করে ইরাকে প্রশিক্ষণ স্থগিত করেছে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস।

পরবর্তীতে জার্মানি বলেছে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করার পরিকল্পনা করেছে তারা। পরিস্থিতিকে সাজানো বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপীয়রা ইরান ইস্যুতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের কৌশলগত শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক কোরি শেক বলেন, প্রতিটি ইউরোপীয় সরকার বিশ্বাস করে যে ইরান থেকে বর্ধিত হুমকি আসার যে দাবি আমরা করছি, তা হচ্ছে- পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য ইস্যুতে ইরানের আত্মসমর্পণের জন্যই বলপ্রয়োগের চেষ্টা।

তার মতে, তাদের বিশ্বাস- যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে উসকানিদাতা এবং ইরানের বিরুদ্ধে হামলার অজুহাত খুঁজতে দেশটির সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ওয়াশিংটন।

ন্যাটোতে সাবেক স্লোভাক রাষ্ট্রদূত এবং কারনেগি ইউরোপের পরিচালক টমাস ভালাসেক বলেন, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগের পরিস্থিতির চেয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই যুদ্ধ ইউরোপকে দুইভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল। ‘এই ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে বলছে- এটা কাণ্ডজ্ঞানহীন। আমাদের এতে থাকা উচিত হবে না। এটা আপনাদের ভুল যে আপনার যুদ্ধের কথা বলছেন।’

আটলান্টিক উপকূলীয় দেশগুলোর একজন সমর্থক হিসেবে তিনি বলেন, সর্বশেষ যে কাজটি আপনাকে করতে হবে তা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন যা করছেন এবং মার্কিন বিরোধিতার ভিত্তিতে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করা।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তেহরানের মাঝের ফাঁদে আটকা পড়েছেন ইউরোপীয়রা। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির সমর্থনে প্রতিশ্রুতিদ্ধ হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শালীন আচরণের চেষ্টা করছেন তারা।

তবে ট্রাম্প ওই চুক্তি নিয়ে প্রথমে অনেক পরিহাস করার পর সেটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে তিনি বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ চান না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, ট্রাম্প না চাইলেও তার কট্টরপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন একটি যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে আছেন।

এক্ষেত্রে নিউইয়র্ক টাইমসে ২০১৫ সালে বোল্টনের একটি লেখার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন তারা। ওই লেখার শিরোনাম ছিল, ইরানের বোমা বন্ধ করতে ইরানে বোমা হামলা করুন।

আর ট্রাম্পের দাবির কথা শুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা বিস্মিত হয়েছেন। নেতাদের ভাষ্য, তিনি (ট্রাম্প) কেবল নতুন একটি আলোচনায় বসতে ইরানকে বাধ্য করতে চাচ্ছেন।

যেখানে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা যেকোনো ঘটনায় ওয়াশিংটনকে শঠ হিসেবে বিবেচনা করেন। স্বীকার করে নেন কিংবা যদি মূল্যায়ন করে দেখেন যে তার আগের প্রেসিডেন্টের যন্ত্রণাদায়ক আলোচনার মাধ্যমে সই করা একটি চুক্তি থেকে তিনি এক ঘোষণা দিয়ে সরে আসলেন।

টমাস ভালাসেক বলেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেহরানের যে সর্বশেষ আলোচনা হয়েছিল, ট্রাম্প সেটি বন্ধ করে দেয়ার পর, তারা কেন ফের আমাদের বিশ্বাস করতে যাবে?

এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডারিকা মঘেরিনি মনে করেন, ইউরোপীয়দের অবস্থান খুবই পরিষ্কার, তা হচ্ছে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বন করতে হবে।

কিন্তু তার জবাবে তেহরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতির কথা বলেছে ওয়াশিংটন। যার মধ্যে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শাস্তিও রয়েছে। বিশেষ করে ইরানি তেল, যেটা দেশটির অর্থনীতির মূল প্রাণশক্তি, সেটির ওপর খড়গ চাপাচ্ছেন ট্রাম্প প্রশাসন।

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস ও তার ব্রিটিশ সমকক্ষ জেরেমি হান্ট একটি আকস্মিক যুদ্ধ এবং তার ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

হান্ট বলেন, অনিচ্ছাকৃত উত্তেজনায় আকস্মিক সংঘাতের ঝুঁকিতে আমরা খুবই হতাশ। আর জার্মান আইনপ্রণেতাদের জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাস বলেন, ইরানের ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করায় এই অনিচ্ছাকৃত ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক যা ঘটেছে, সেটা পাইপলাইন কিংবা জাহাজের নাশকতা হোক, তা এই আভাস দিচ্ছে যে এই ঝুঁকি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবিক।

ইরান ও তার মিত্রদের কাছ থেকে মার্কিন বাহিনীর ওপর বাড়তি হুমকি কিংবা মার্কিন হুশিয়ারি নিয়ে প্রাথমিকভাবে সন্দিহান হলেও অধিকাংশ ইউরোপীয় কর্মকর্তা এখন মার্কিন সতর্কতাকেই গ্রহণ করেছেন। যদিও তাদের কাছে মনে হচ্ছে, মার্কিন পদক্ষেপ বাড়াবাড়ি ও উসকানিমূলক।

‘আমেরিকান চাপের ফলে ইরানের জবাব নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা পেন্টাগন, সেন্টকম ও মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর আগাম সতর্কতা,’ বললেন ভালাসেক।

‘কাজেই ইউরোপীয়রা একধরনের উত্তেজনার মধ্যে রয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র এমন একনীতিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, যেটা তাদের মতে সম্পূর্ণ ভুল। এ ছাড়া পেন্টাগন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও ইউরোপীয়রা যে পরিণতির কথা ট্রাম্পকে বলেছেন, তা সঠিক না।’

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, ইরান তার নিজস্ব সুবিধাগুলো সেক্ষেত্রে কাজে লাগাবে। যার মধ্যে রয়েছে, নতুন করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং তাদের আঞ্চলিক মিলিশিয়া ও ছায়াবাহিনীর কাছে অস্ত্র হস্তান্তর করবে ইরান। আঞ্চলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র যেটার সামঞ্জস্যহীনভাবে জবাব দিয়ে আসছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের গবেষণা পরিচালক জেরেমি শাপিরা বলেন, ইরানিরা সম্ভবত ওয়াশিংটনের কট্টরপন্থার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছেন। ছায়াবাহিনীর মাধ্যমে ইরান এক পা সামনে বাড়ানোর অর্থ হচ্ছে তারা উত্তেজনার পারদ এক-অষ্টমাংশ বাড়াচ্ছেন। দেশটি এভাবেই নিজের বার্তাগুলো পাঠাচ্ছে।

তিনি বলেন, তারা পাণ্ডুলিপির অনুসরণ করে চলছেন। ইরানি ও মার্কিন কট্টরপন্থীরা একটা বিষাক্ত মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন এবং পরস্পর উত্তেজনাগুলো গিলছেন।

১৯৯০-৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশাল বহুজাতীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়েছে। আর ২০০৩ সালের দ্বিতীয় যুদ্ধে সেই সংখ্যা কমে কেবল ব্রিটেন ও পোল্যান্ড অংশ নিয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনই বর্তমান ইউরোপীয়দের সন্দেহের শিকড়। তখন ভুয়া অভিযোগ ও বাড়াবাড়িমূলক গোয়েন্দা তথ্য দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

এতে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের অনুগত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও পোল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার কিসওনস্কি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন।

মার্কিন গবেষক জেরেমি শাপিরা বলেন, পরবর্তীতে তারা ক্ষমতাচ্যুত এবং বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। কাজেই সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার কোনো সুযোগ ব্রিটেনে নেই। যদি মার্কিন নীতি হয় জবরদস্তিমূলক, তবে তাতে ইউরোপীয় সমর্থন থাকবে না।

ইতিমধ্যে বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা পদক্ষেপে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে। কেবল ইরান নয়, ইসরাইল ও রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।

শাপিরা বলেন, ইরানের ঘটনায় ইউরোপের কাছ থেকে খুব বেশি সহায়তা প্রত্যাশা করছে না ট্রাম্প প্রশাসনের কেউ। এদিকে ইউরোপীয়রা কী ভাবছে, তাতে ট্রাম্প প্রশাসন খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

তার মতে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ব্রাসেলস সফরে এসে একটা চেষ্টা করেছেন। ইরানের বাড়তি হুমকি নিয়ে আমেরিকান মূল্যায়ন ও সার্বিক ইরান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এতে ইউরোপের প্রশাসনের অভ্যন্তরের বিতর্কে ইউরোপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে।

শাপিরার মতে, যদি সেখানে কোনো মৌন সমর্থন থাকে কিংবা তারা একেবারে বিরত থাকেন, তবে তা অভ্যন্তরীণ বিতর্কে সহায়ক হবে। মিত্ররা আমাদের সঙ্গে আছে নাকি, বিপরীতে তা জানা যাবে।

ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের বিবেচনা, ইরান নিয়ে ওয়াশিংটনের বিতর্কের কিছু বাকি নেই। তারা সবচেয়ে ভালো জিনিসটিই চাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি নোংরা যুদ্ধে আমেরিকার জড়ানোতে ট্রাম্পের অনিচ্ছাতেই তাদের স্পষ্ট সমর্থন থাকবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post