তুরস্কের স্থানীয় নির্বাচন; চ্যালেঞ্জের মুখে এরদোগান


মোস্তফা ফয়সাল: আজ ৩১ মার্চ তুরস্কের স্থানীয় নির্বাচন। তুরস্কের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, কাউন্সিলর, গ্রাম সরকারসহ সমগ্র তুরস্কে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রায় ৫ লক্ষাধিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্য এরদোগানের একে পার্টি ও জাতীয়তাবাদী দল এম এইচপি কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জোটবদ্ধ হয়েছে।

ইস্তানবুল, আঙ্কারার মত গুরুত্বপূর্ণ শহরে যেমন এমএইচপি একে পার্টিকে ছাড় দিয়েছে তেমনি একে পার্টি আদানা, ইস্পার্তা, মানিসার মত শহরে এমএইচপিকে ছাড় দিয়েছে।

অপরদিকে আতার্তুকের সিএইচপি এবং গুড পার্টি জোটবদ্ধ হয়েছে। কুর্দিশ জাতীয়তাবাদী দল এইচডিপি এবং সাদাত পার্টি যে সমস্ত স্থানে প্রার্থী দেয়নি সেখানে তাদের ভোট আতার্তুকের সিএইচপি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তুরস্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা "ডেইলি সাবাহ" এর মতে, ৩৪০ জন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পিকেকের সদস্যরা সিএইচপি, গুড পার্টি এবং সাদাত পার্টি থেকে নির্বাচন করছে। মূলত এইচডিপির এই প্রার্থীরা অভ্যন্তরীণ সমঝোতার মাধ্যমে একে পার্টিকে পরাজিত করতে অন্য দল থেকে নির্বাচন করছে বলে পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে এবং যেখানে পিকেকের সাবেক সদস্যরাও নমিনেশন পেয়েছে।

তুরস্কের রাজনীতিতে ইস্তানবুল এবং আঙ্কারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিমকে ইস্তানবুল মেয়র প্রার্থী করায় আশা করা হচ্ছে ইস্তানবুলে সহজে একে পার্টি জয়লাভ করবে। একে পার্টি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এরদোগানের নেতৃত্বে জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী হয়ে আসছিল।

১৯৯৪ সালে তুরস্কের স্থানীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থিদের যে বিজয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজও থামেনি। তবে এই নির্বাচনে আঙ্কারা সিটি কর্পোরেশন নিয়ে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে এরদোগান ও একে পার্টি সরকার। গুরুত্বের দিক দিয়ে রাজধানী আঙ্কারার অবস্থান ইস্তানম্বুল সিটির পরেই। অতীতে ইজমীর ব্যতিত ইস্তানবুল, আঙ্কারা, কোনিয়া, বুরসা, কায়সেরি, আনতালিয়া, গাজি আনতেপের মত গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে নাজমুদ্দিন আরবাকানের রেফাহ পার্টির সফলতার ধারাবাহিকতায় একে পার্টিও তা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।

ইতিমধ্যে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এরদোগান আঙ্কারা সিটির সকল পৌরসভায় জনসভা করে ভোট চেয়েছেন যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু রাজধানী আঙ্কারায় কেন এরদোগান এবং একে পার্টি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?

প্রথমত, ১৯৯৪ সাল থেকে আঙ্কারার নির্বাচিত মেয়র ছিলেন মেলিহ গোকচেক। কিন্তু এরদোগানের সঙ্গে কিছু বিষয়ে মত পার্থক্য থাকায় ২০১৭ সালে তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। একে পার্টির নতুন মেয়র প্রার্থী মেহমেত ওয়াজহাসেকি ইতিপূর্বে সরকারের মন্ত্রী ও কায়সেরি সিটি মেয়র ছিল। অন্য শহরের সাবেক মেয়র রাজধানী আঙ্কারায় প্রত্যাশিত আবেদন তৈরি করতে পারেনি।

অপরদিকে একে পার্টির প্রার্থীর তুলনায় সিএচপির প্রার্থী মানসুর ইয়াবাস তুলনামুলক বেশি পরিচিত এবং ২০১৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুরস্কের চলমান দ্বন্দ্বের কারণে সম্প্রতি তুরস্কের মুদ্রা লিরার বিপরীতে ডলারের মুল্য ২৫% বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ওপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। এই প্রভাব নিঃসন্দেহে আঙ্কারাসহ সকল সিটির ওপর পড়েছে।

তৃতীয়ত, তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন সিরিয়ান জনগোষ্ঠী অবস্থান করায় তার্কিশরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। জনসংখ্যার একটা বড় অংশ মনে করে এরদোগানের অতি মাত্রায় উদারতার কারণে সিরিয়ানরা তুরস্কে অবস্থান করছে। অপরদিকে বিরোধী দলগুলোর সিরিয়ানদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তারা কিছুটা হলেও বেশি ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

চতুর্থত, একে পার্টি দীর্ঘদিন এককভাবে ক্ষমতায় থাকায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা অসন্তুষ্টি রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ড. আহমেদ দাউদউলু দল থেকে বিতাড়িত হওয়ায় বিনালি ইলদিরিমের অনুসারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, ফলে আব্দুল্লাহ গুল ও দাউদউলুর অনুসারীদের মনোকষ্ট রয়েছে।

আঙ্কারায় এরদোগান এবং বিনালি ইলদিরিমের পছন্দের প্রার্থী মেহমেত ওয়াজহাসেকি অন্য শহরের হওয়ায় আঙ্কারার স্থানীয়রা এবং আব্দুল্লাহ গুল ও দাউদউলুর প্রার্থীরা ইতিবাচকভাবে গ্রহন করেনি।

৩০ মার্চের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী আঙ্কারায় একে পার্টির প্রার্থী মেহমেত ওয়াজহাসেকির সমর্থন ৪৮% এবং সিএইচপির মানসুর ইয়াবাসের সমর্থন ৪৭.৫%। তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে কোনো কারণে যদি একে পার্টির প্রার্থী আঙ্কারায় জয়ী না হয় তাহলে এখান থেকেই হয়ত এরদোগানের বিজয়রথ থেমে যাবে।

লেখক: মোস্তফা ফয়সাল
পিএইচডি গবেষক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন বিভাগ
গাজি ইউনিভার্সিটি, আঙ্কারা, তুরস্ক

Post a Comment

Previous Post Next Post