বিশেষ প্রতিনিধিঃ
কুলাউড়ার পরিচিত মুখ সদা হাস্যোজ্জ্বল আব্দুল হান্নান (নিজ গাড়ি ও
ড্রাইভার গিয়াসসহ) 'অপহরণ' হওয়ার ২২ বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবু আজও কোনো খোঁজ
মেলেনি আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগীর। পুত্র শফিউল আলম সৌরভ অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমরা আর কতকাল এভাবে পথ চেয়ে থাকব।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সাল। বছর ঘুরে এ দিনটি আসলে কুলাউড়ার ওই পরিবারের কাছে পিতা হারানোর স্মৃতি অকপটে ভেসে ওঠে। অন্যান্য দিনের মতো সে দিনও পূর্ব আকাশে বিজয় দিবসের রক্তিম সূর্য উদয় হয়েছিল। অন্যান্য দিনের মতো সে দিনও বিজয় দিবসের বাতাস হু হু হয়ে বইছিল। আর এই বাতাসের মধ্যে কি যেন এক হাহাকার ভরা বেদনা ছিল কুলাউড়াবাসীর জন্য তাই-বা কে জানত?
কুলাউড়ার ডাকবাংলো মাঠে বিজয় মেলা ৯৫ এর সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। কুলাউড়াবাসীর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচত সাতজন যুবক মেলায় অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা করে মেলা থেকে বেরিয়েই প্রায় ৩০০ গজ উত্তরে গিয়ে রাস্তায় একটি লাইটেস দাঁড়ানো দেখে ড্রাইভারকে তারা জানায় যে, তারা ঢাকার বাসিন্দা। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে এসেছিলেন। তারা ঢাকায় ফেরত যেতে চায়। লাইটেসের ড্রাইভার তাদেরকে ৩৫০০ টাকা ভাড়া দাবি করে। ড্রাইভার গিয়াস যখন যুবকের সাথে আলাপ করে তখন গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান সেখানে উপস্থিত হন। আব্দুল হান্নান অবশেষে ঢাকার মালিবাগে যুবকদের নিয়ে যেতে রাজি হন। ১২০০ টাকা অগ্রীম এবং বাকি টাকা ঢাকা যাবার পর দেবার সিদ্ধান্ত হয়।
তখন সন্ধ্যা ৭টা। মাইক্রোবাসটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-০২-৪৫৭৭ ড্রাইভার গিয়াস যাত্রীবেশী কথিত যুবক ও গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নানকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। ঢাকায় যাবার পর সেই থেকে আজ অবধি গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান ও ড্রাইভার গিয়াস নিখোঁজ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সাল। কেটে গেল ২২ বছর। কিন্তু পরিবার-পরিজন এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন, তারা ফিরবেন।
আব্দুল হান্নান কুলাউড়া পৌরশহরের উছলাপাড়া নিবাসী মরহুম আব্দুস ছত্তারের প্রথম পুত্র। নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের ছোটভাই স্পেনপ্রবাসী সাংবাদিক তুতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, আব্দুল হান্নান ও ড্রাইভার গিয়াস গাড়িসহ অপরহণ করা হয়েছে বলে ঘটনার দুই দিন পর অনুমান করা হয়। তারা ফিরে না আসাতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কুলাউড়া থানায় জিডি করা হয়। জিডি নম্বর ৬৫১ (তারিখ ১৮.১২.১৯৯৫) এবং পরে এজাহার (নম্বর ১৫ তারিখ ২৫/১২/১৯৯৫) দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে এটি ডিবিতে স্থানান্তরিত হয়। ১৫ এপ্রিল ৯৬ ডিবি থেকে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি নিখোঁজ ব্যক্তিদ্বয়সহ ছিনতাইকৃত গাড়িটি উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
হান্নান নিখোঁজের ৭ মাস পর স্ত্রী শেফালী জন্ম দেন পুত্র পায়েলের। আব্দুল হান্নানের ৩ পুত্রের মধ্যে রুবেল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ, শফিউল আলম সৌরভ মাস্টার্সে ও পায়েল হিফজ শেষ করে আলিম এ অধ্যয়নরত। নিখোঁজ হান্নানের পুত্র সৌরভের মনে আজও প্রশ্ন জাগে বাবা ফিরবে তো, বাবাকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে তো? সদা হাস্যোজ্জ্বল হান্নান দীর্ঘ ২ দশক থেকে নিখোঁজ। মরে গেছে না বেঁচে আছে কেউ জানে না। কুলাউড়াবাসীর মধ্যে সেই থেকে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। জলজ্যান্ত দুটি মানুষ গাড়িসহ উধাও হয়ে গেল। অথচ কেউ আজও তাদের কোনো সন্ধান দিতে পারল না।
আব্দুল হান্নানের স্ত্রী শেফালি অশ্রুশিক্ত নয়নে পথপানে আজও তাকান স্বামী ফিরবেন এ আশায়। হান্নানের ভাই-বোন ও সন্তানেরা আজও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তারা হান্নানের সন্ধান চান। জানতে চান তাদের হান্নান বেঁচে আছে নাকি পৃথিবী থেকে চলে গেছে।
পুত্র শফিউল আলম সৌরভ অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমরা আর কতকাল এভাবে পথ চেয়ে থাকব। দেশে এখন ঘুম-খুন, অপহরণ অহরহ ঘটলেও তৎকালীন ড্রাইভার, গাড়িসহ আব্দুল হান্নানের নিখোঁজের বিষয়টি কুলাউড়াসহ সিলেট বিভাগজুড়ে ব্যাপক আলোচিত ছিল।