সমঝোতা না হওয়ায় শঙ্কা তৈরি হয়েছে


অনলাইন ডেস্কঃ সরকারের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দু’দফা সংলাপের পর আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু পাওয়া গেল না। সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে সংলাপ এবং আরও আলোচনা হওয়ার কথা বলা হলেও দৃশ্যত সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। সমঝোতা না হওয়ার বিষয়টি দুশ্চিন্তার।

এর মাধ্যমে রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষ অধীর আগ্রহে সংলাপের দিকে তাকিয়েছিল সুন্দর পরিবেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশায়।

সংলাপ শুরুর মাধ্যমে সে সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল এবং বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দু’দফায় সংলাপের পর বিশিষ্ট নাগরিকরা টেলিফোনে যুগান্তরকে এভাবেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, বিরোধী পক্ষ যেসব দাবি তুলেছে তার মধ্যে বেশকিছুতে ছাড় দেয়া সম্ভব। যেগুলো আদালতের বিষয় নয়, সেখানে কোনো পক্ষ কী ছাড় দেবে- তা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আরও ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ আলোচনার প্রয়োজন। সংলাপের সেই সময় শেষ হয়ে যায়নি।

রাজনীতিবিদদের শুভবোধের প্রত্যাশায় সদিচ্ছা, নেতৃত্ব ও ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে আবারও সংলাপের পরামর্শ তাদের। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, তড়িঘড়ি তফসিল ঘোষণা না করে এ মাসের মাঝামাঝিও ঘোষণা করা যায়। ঐকমত্যে পৌঁছে তফসিল ঘোষণা মঙ্গলজনক। তফসিলের পর আলোচনার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। হুশিয়ারি উচ্চারণ করে তারা বলছেন, ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিকল্প নেই। সংলাপ ব্যর্থ হলে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ পুরো দেশের জন্য নেতিবাচক বার্তাই দেবে।

কথা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ‘আশা-নিরাশার মাঝামাঝি আছি।’ বুধবার বিকালে টেলিফোনে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের দুই দফা সংলাপ হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। সমঝোতা না হওয়াটা দুশ্চিন্তার। আমরা অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। এজন্য সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ দরকার, তা এখনও তৈরি হয়নি।

সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন হতে হবে সংবিধান অনুযায়ী। তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা না করে নভেম্বরের মাঝামাঝি করা যায়। যেহেতু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছে তফসিল ঘোষণা করলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো।

ঐক্যফ্রন্টের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এই দাবিটিকে অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই। কারণ এখানে মধ্যবর্তী কোনো স্থান নেই। একই সঙ্গে দুটি সংসদ চলতে পারে না।

নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবিতে উভয়পক্ষে আলোচনা হতে পারে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নিরপেক্ষ সরকার গঠন সময়ের দাবি। এটাকেও অযৌক্তিক বলা অনাকাক্সিক্ষত।

খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ দাবি সরকার মানবে বলে মনে হয় না। বিষয়টি আইনি বলে পাশ কাটানোর সুযোগ রয়েছে। তবে একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য অবশ্যই উভয়পক্ষের ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ আলোচনা প্রয়োজন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে, তাতে সন্তোষজনক কোনো অগ্রগতি নেই। বলা যায়, এ পর্যন্ত সংলাপ সফল হয়নি। তবে সময় শেষ হয়ে যায়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষ হয়েছে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক চলতে পারে। তবে সন্তোষজনক অগ্রগতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছাড় দেয়ার মানসিকতা না থাকলে সমঝোতা সম্ভব নয়। সংলাপ ব্যর্থ হলে তা রাজনীতি, অর্থনীতিসহ পুরো দেশের জন্যই নেতিবাচক বার্তা।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা হল দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমঝোতা না হলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনিতেই আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা খুবই খারাপ। সেটি আরও নেতিবাচক হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এছাড়া বিভিন্ন কারণে আমাদের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে একটি সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যাতে সমস্যা গভীর হবে, এটি বলা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘আমি কিছুটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছি।’ দ্বিতীয় দফা আলোচনা শেষে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেছেন, আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতা মান্না বলেছেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, সব দাবি মেটানো সম্ভব নয়। দু’ধরনের এই বক্তব্য আমার ভেতরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। বুধবার সন্ধ্যায় ফোনালাপে যুগান্তরকে তিনি বলেন, একদিকে আলোচনা বা সংলাপ হচ্ছে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার থেকে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। বুঝতে হবে, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।

অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, তফসিল ঘোষণার পরও আলোচনা চলবে- এমন কথাও বলা হয়েছে। তবে আমার মনে হয়, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে আলোচনার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কারণ তফসিল হয়ে গেলে সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখন আন্দোলন করলেও জনসমর্থন পাওয়া যাবে না।

ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক আনোয়ার। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে তৎকালীন সরকারকে দাবি মানতে যে ধরনের অসহযোগ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, তেমন আন্দোলন ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ তখন বিরোধী দলে ছিল আওয়ামী লীগ। এ দলটির তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠিত কর্মী বাহিনী রয়েছে।

কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের বেশির ভাগ দলেরই তেমন অবস্থা নেই। এদের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ড. কামাল হোসেন। তিনি দেশে অত্যন্ত সুপরিচিত। তার রাজনৈতিক দলের নাম গণফোরাম হলেও সে দলের সঙ্গে গণসম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। তাই ঐক্যফ্রন্ট মাঠে থাকার ঘোষণা দিলেও তারা তেমন শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আপসের ওপর গুরুত্বারোপ করে এ ইতিহাসবিদ বলেন, সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হয়েছে। আলোচনার পথ সৃষ্টি হয়েছে। তাই সামগ্রিক কল্যাণের বিষয় মাথায় রেখে তাদের উচিত নির্বাচনের একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংলাপ ব্যর্থ হওয়ায় দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। এ ধরনের পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক নয়। তিনি বলেন, এখনও সময় আছে। ফলে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনীতিবিদদের অবশ্যই সমঝোতায় আসা উচিত।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সমঝোতার জন্য কয়েকটি বিষয় জরুরি। যা হল- সদিচ্ছা, নেতৃত্ব ও ছাড় দেয়ার মানসিকতা। সুজন সম্পাদক বলেন, একজন নাগরিক হিসেবে দেশে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করছি। কোনো নাগরিক সহিংসতা চায় না। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র রক্ষায় একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন অবশ্যই জরুরি। দোয়া করছি, রাজনীতিবিদদের শুভবোধের উদয় হোক। -
যুগান্তরকে

Post a Comment

Previous Post Next Post