থামছে না ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ; বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা


অনলাইন ডেস্কঃ ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০টি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের ভাষ্য, সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে এবং বিভিন্ন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রেলওয়েতে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ট্রেন, স্টেশনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও। পাথর নিক্ষেপে বছরে ট্রেনের জানালা ও ইঞ্জিনের ১৪ হাজারের মতো গ্লাস ভাঙছে। এ গ্লাস পাল্টাতে ও মেরামতে বছরে ৪০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে রেলওয়েতে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী, ট্রেনের যাত্রী আহত ও নিহতের ঘটনা ছাড়াও পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে না। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রেলওয়েতে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় প্রায় ৫০ যাত্রী ও রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী কম-বেশি আহত হয়েছেন।

চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পরিদর্শক বায়োজিদ শিকদার। ট্রেনটি বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে দৌলতপুর স্টেশন এলাকায় পৌঁছলে দুর্বৃত্তরা পাথর ছুড়ে মারে। এতে বায়োজিদ শিকদার আহত হন। পরে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় এনে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এর কিছুদিন পর তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বায়োজিদ মারা যান। ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট ফেনীতে চলন্ত ট্রেনে পাথরের আঘাতে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ প্রাণ হারান।

ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ জঘন্যতম অপরাধ জানিয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন জানান, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে শুধু যাত্রী নন রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আহত হচ্ছেন। যাত্রীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও মৃত্যু হচ্ছে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মানুষ চিন্তাও করতে পারে না যে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করবে। পাথর নিক্ষেপ করা এলাকাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ জনসচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। তারপরও ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে।

তিনি বলেন, ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রেলওয়েতে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটে। এতে রেলওয়ের প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ ও রেলপথে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড রোধে রেলওয়েও কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।

রেলওয়ে অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের ২০টি জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলা। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসেবে ৬৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৯টি।

রেলওয়ে পুলিশের বক্তব্য, চিহ্নিত স্থানগুলোতে সর্বদা পুলিশি পাহারা বসানো সম্ভব নয়। তাছাড়া রেলওয়েতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বল্পতাও রয়েছে। পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করতে হলে সর্বপ্রথম মানুষকে সচেতন হতে হবে। পারিবারিক-সামাজিক শিক্ষাই পারে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা রোধ করতে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামীতে যে কোনো আন্দোলন কিংবা নির্বাচনকে ঘিরে রেলওয়েতে কোনো নাশকতা রোধের পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রেলপথমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে যে কোনো মূল্যে ট্রেন যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে যা যা করার তা করা হবে।

ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি মো. ইয়াছিন ফারুকী জানান, দেশে আন্দোলন হলেই রেলওয়েতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। সোমবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে দুষ্কৃতকারীরা ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে ১৮টি গ্লাস ভেঙে দেয়। তাছাড়া রেলওয়েতে প্রতিদিন কোনো না কোনো ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের খবর আসছেই। তবে পাথর নিক্ষেপ ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা রোধে ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগিতে রেলওয়ে পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ইতিমধ্যে সকর্তাবস্থানে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান জানান, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিনিয়তই ট্রেনের গ্লাসসহ জানালার বিভিন্ন অংশ মেরামত ও পাল্টাতে হচ্ছে। প্রতিদিন এ অঞ্চলে ১৮ থেকে ২০টি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। একেকটি গ্লাস মেরামত বা পাল্টাতে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগছে। লালমনিরহাট বিভাগের সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌলশী রবিউল ইসলাম জানান, এ অঞ্চলে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা অহরহ ঘটছে। গ্লাস ভাঙলে অরজিনালটা পাওয়া যায় না। নতুন ট্রেনের সঙ্গে থাকা গ্লাসগুলো খুবই ভালো থাকে।

পাকশি রেলওয়ে বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী ময়েন উদ্দিন সরকার জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত তার অঞ্চলে ২৬শ’র ওপরে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ ট্রেন চলায় ট্রেনের জানালা কিংবা ইঞ্জিনের গ্লাস খুব বড় হয়। এসব গ্লাসের দাম মিটার গেজের জানালার গ্লাসের চেয়ে অনেক বেশি। ভাঙা এক একটি গ্লাস পাল্টাতে ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।

রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুড়লে যাবজ্জীবন জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর নিক্ষেপে যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারা মতে দোষীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। কিন্তু পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারও করা যাচ্ছে না, তাদের আইনের আওতায়ও আনা যাচ্ছে না। #যুগান্তর

Post a Comment

Previous Post Next Post