অনলাইন ডেস্কঃ ১১৯তম হিসেবে ই-পাসপোর্ট ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ঢুকছে বাংলাদেশ। এ কাজে প্রযুক্তিগত সুবিধার জন্য জার্মানির ভেরিডোস জিএমবিএইচের সঙ্গে গত সপ্তাহে চুক্তিও হয়ে গেছে। ডিসেম্বর থেকে এই পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে চলা এমআরপি পাসপোর্টের সঙ্গে ই-পাসপোর্টের প্রযুক্তিগত পার্থক্য ও বাড়তি সুবিধা নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আল-আমীন দেওয়ান
ই-পাসপোর্ট কী
বিষয়টা ব্যাংকে চেক আর এটিএম কার্ড দিয়ে টাকা তোলার পার্থক্যের মতো। চেক দিয়ে তুলতে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তারা স্বাক্ষর, পরিচয়, ব্যালেন্স ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে টাকা দেন। আর এটিএম বুথে গিয়ে কার্ড প্রবেশ করিয়ে পিন নম্বর ও টাকার অঙ্ক দিলে টাকা বেরিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য যাচাই করে নেয়।
তেমনি মেশিন রিডেবল (এমআরপি) পাসপোর্টে মুখোমুখি হতে হয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার। তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেন। আর ই-পাসপোর্ট দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হওয়া অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ। কিয়স্কে (ব্যাংকের এটিএম মেশিনের মতোই) পাসপোর্ট স্ক্যান করলে ব্যক্তি পরিচয়সহ অন্যান্য তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই হয়ে গেইট খুলে যাবে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হবে না। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্টধারীর পরিচয় ও তথ্য জালিয়াতির আশঙ্কা একেবারে ক্ষীণ। তথ্যের গোপনীয়তাও নিশ্চিত হয়।
কী থাকে
ই-পাসপোর্ট দেখতে এমআরপি পাসপোর্টের মতোই। তবে এতে প্রযুক্তিগত অনেক পার্থক্য আছে। যেমন এতে শনাক্তকরণ চিহ্ন থাকে। পাসপোর্টের সঙ্গে স্মার্ট কার্ড প্রযুক্তির মতো মাইক্রোপ্রসেসর চিপ এবং অ্যান্টেনা বসানো থাকে। এর প্রতিটি পাতায় খুব সূক্ষ্ম ডিজাইনের জটিল সব জলছাপ থাকে।
এমআরপি পাসপোর্টের শুরুতে ব্যক্তির তথ্যসংবলিত যে দুটি পাতা দেওয়া হয়, ই-পাসপোর্টে তা থাকবে না। এর বদলে বসবে পলিমারের তৈরি কার্ড। এই কার্ডে বসানো চিপের মধ্যে থাকবে পাসপোর্ট মালিকের সব তথ্য।
ই-পাসপোর্টে এই ডকুমেন্ট ও চিপসংক্রান্ত তথ্য জমা রাখা হয় ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) ই-পাসপোর্টের স্পেসিফিকেশন ডক ৯৩০৩-এর নিয়ম মেনে। এই নিয়মে শনাক্তকরণ পদ্ধতি হতে হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেসিয়াল এবং আইরিস রিকগনিশন বায়োমেট্রিকসে। এই বায়োমেট্রিক ফাইল ফরম্যাট এবং যোগাযোগ প্রটোকল নির্ধারণ করে দেয় আইসিএও।
ডিজিটাল চিপে ছবি সাধারণত জেপিইজি বা জেপিইজি২০০০ ফরম্যাটে থাকে। চিপের বাইরে ইলেকট্রনিক বর্ডার কন্ট্রোল পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিক ফিচারগুলো যাচাই করা হয়।
কনটাক্ট ছাড়া চিপে ডাটা রাখতে কমপক্ষে ৩২ কিলোবাইট ইইপিআরওএম বা ইইপ্রম স্টোরেজ মেমোরি থাকে। এই মেমোরির বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে অপেক্ষাকৃত কম জায়গা থাকলেও এর প্রতিটি বাইট আলাদাভাবে ডিলিট করা বা নতুন করে প্রগ্রাম করা যায়। এর ফলে পাসপোর্টে হালনাগাদ করার সুবিধা থাকে।
যত নিরাপত্তা
ই-পাসপোর্টের তথ্য চুরি বা এর নকল করা এবং তা কাজে লাগানো প্রায় অসম্ভব। পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, আমাদের ই-পাসপোর্টে ৩৮ ধরনের নিরাপত্তা ফিচার থাকবে। অন্যান্য নিরাপত্তাব্যবস্থার সঙ্গে প্রধানত এই পাসপোর্টে ‘নন-ট্রেইসেবল’ চিপ ব্যবহার করা হয়। ফলে সাইবার আক্রমণ থেকেও সুরক্ষিত থাকবে।
চিপ শনাক্তকরণের প্রতিটি কমান্ডের বিপরীতে পৃথক চিপ নম্বর থাকে। আর চিপে থাকা তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে পাবলিক কি ইনফ্রাস্ট্রাকচার (পিকেআই) ব্যবহার করা হয়। এই পাসপোর্টে সাপ্লিমেন্টাল অ্যাকসেস কন্ট্রোল (এসএসি) পদ্ধতিতে চিপ ও রিডারের মধ্যে এনক্রিপটেড তথ্য বিনিময় হয়। ফলে এখানে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি থাকে না।
ই-পাসপোর্টে কোনো তথ্যের পরিবর্তন ধরতে ব্যবহার করা হয় প্যাসিভ অথেনটিকেশন (পিএ)। নকল পাসপোর্ট চিপ তৈরি আটকাতে এতে রয়েছে অ্যাকটিভ অথেনটিকেশন (এএ)। এ পদ্ধতি ব্যবহারে চিপ এবং রিডার উভয়েরই নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা করা হয়।
পাসপোর্টের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং আইরিস স্ক্যান নিরাপদ রাখতে ব্যবহার করা হয় এক্সটেনডেড অ্যাকসেস কন্ট্রোল (ইএসি) পদ্ধতি। এতে চিপ ও রিডারের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা হয়।
ই-পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগ
‘ই-পাসপোর্ট বাস্তবায়ন ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা’ নামে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। কাজে সহযোগিতার জন্য চুক্তি হয়েছে জার্মানির ভেরিডোস জিএমবিএইচ কম্পানির সঙ্গে। চার হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা প্রকল্প মূল্যের মধ্যে ভেরিডোসের সঙ্গে চুক্তি তিনি হাজার ৩৩৮ কোটি টাকার। কাস্টমস শুল্ক, ভ্যাট এবং এআইটি রয়েছে এক হাজার ২৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের অন্যান্য খরচ ২০৭ কোটি টাকা।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর জানায়, ভেরিডোস জিএমবিএইচ তিন কোটি ই-পাসপের্টি বুকলেট সরবরাহ করবে। ই-পাসপোর্ট সংযোজন কারখানা হবে ঢাকার উত্তরায়। এতে তৈরি ই-পাসপোর্ট বুকলেট আমদানির চেয়ে সংযোজনের মূল্য অর্ধেকের চেয়েও কম পড়বে। বিমান ও স্থলবন্দরে চাহিদা মোতাবেক ৫০টি ই-গেট স্থাপন করা হবে। সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্ক ১০ বছরের জন্য রক্ষণাবেক্ষণও করবে ভেরিডোস।
পাশাপাশি নতুন স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাটা সেন্টার, ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার এবং অত্যাধুনিক পার্সোনালাইজেশন সেন্টার নির্মাণ করা হবে। পার্সোনালাইজেশন সেন্টারে থাকবে আটটি প্রিন্টিং মেশিন। এই মেশিনগুলো থেকে প্রতি শিফটে ৩০ হাজারেরও বেশি পাসপোর্ট প্রিন্ট করা যাবে।
দেশের ৭২টি পাসপোর্ট অফিস, বিদেশে ৮০টি মিশন, ৭২টি এসবি এবং ডিএসবি অফিস, ২২টি ইমিগ্রেশন চেকপোস্টসহ সব অফিসে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশের ১০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জার্মানিতে নিয়ে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেবে ভেরিডোস।
সুবিধা ও কার্যপদ্ধতি
কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল গেট চালু হয়েছে। এসব দেশে লম্বা লাইনের বিড়ম্বনা বদলে যাত্রীরা দ্রুতই ইমিগ্রেশন পেরোতে পারছেন। এতে তথ্যের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও যাত্রীর গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে ঠিকঠাক। বর্ডার পার হওয়ার সময় যাত্রীর পরিচয় নিশ্চিত হচ্ছে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে। এয়ারপোর্ট বা বর্ডার পার হওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিচয় নির্ণয় হচ্ছে।
ই-পাসপোর্টের সব তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত থাকে পাবলিক কি ডিরেক্টরি বা পিকেডিতে। আইসিএও-এর নিয়ন্ত্রণে থাকা এই তথ্যভাণ্ডার থেকে তথ্য যাচাই করতে পারে ইন্টারপোলসহ বিশ্বের সব বিমান ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। কেউ ই-পাসপোর্টে কোনো দেশের দূতাবাসে ভিসার আবেদন করলে দূতাবাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই তথ্যভাণ্ডারে ঢুকে তথ্য যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
কবে মিলবে?
১১৮টি দেশে এরই মধ্যে ই-পাসপোর্ট চালু হয়েছে। ১১৯তম হিসেবে বাংলাদেশ এই তালিকায় ঢুকছে। পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ই-পাসপোর্টের মেয়াদ হবে বয়সভেদে পাঁচ ও দশ বছর। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকেই এই পাসপোর্ট চালু করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ই-পাসপোর্ট চালু হলে পাশাপাশি এমআরপিও চলবে। তবে কারো এমআরপি পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নতুন করে পাসপোর্ট নেওয়ার সময় ই-পাসপোর্ট দেওয়া হবে।
এমআরপি পাসপোর্টের তুলনায় ই-পাসপোর্ট তৈরির খরচ প্রায় আড়াই শ টাকা কম হবে বলে জানা গেছে। সুত্রঃ কালেরকন্ঠ