'' দস্যি মেয়ে '' - ডা. সাঈদ এনাম

'' দস্যি মেয়ে '' - ডা. সাঈদ এনাম
ডা. সাঈদ এনামঃ লোপা ত্রপা যমজ বোন। বয়স কতইবা হবে, আনুমানিক নয় কি দশ। দেখতে একই রকম। যমজ'রা সাধারণত যেমন হয়। একজন ফরসা,একজন শ্যমলা। ব্যাস এটুকুই শুধু তফাৎ। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশুনা । এর পর স্কুলের পাঠ শেষ। স্কুলে যাওয়া  বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পড়াশুনা করে না বা পারেনা  এজন্যে না। বরং তাদের জ্বালায় বাকিরা কেউ পড়তে পারেনা, এজন্যেই তাদেরকে স্কুল থেকে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে। তাদের দুস্টুমি আর উৎপাতে শিক্ষকরা, অভিভাবক রা অতিষ্ট।

স্কুলে গেলেই ক্লাসে জানালা দিয়ে পালিয়া যেয়ে একজন লাফ দিয়ে উঠে যায় টিনের চালে, আরেকজন গাছের ডালে। একেবারে মগডালে। কোন ভয় নেই। তার পর সেখান থেকেই দুজনে শুরু করে ঝগড়া। এ যেনো আজম খানের সেই বিখ্যাত  গানের মতো
আলাল যদি ডানে যায়,
দুলাল যায় বামে,
তাদের বাবা সারাদিন
খুজে খুজে মরে....!

ছেলে হলে কথা ছিলো একটু মানিয়ে নিতো সবাই, দুস্টু ছেলে পুলে বলে এটা ওটা বলে বুঝ দেয়া যেতো, কিন্ত সমস্যা মেয়ে বলে। মেয়েতো নয় একেবারে দস্যি মেয়ে!!

এইতো ক'দিন আগে দুজনে মিলে করেছে এক কান্ড!
স্কুলের দপ্তরী কে মিলে দুজনে সেকি মার। সাদাসিধে দপ্তরী ছেলেটাকে মেরে মেরে আধমরা। এতটুকুন বাচ্চা দুটো মেয়ে স্কুলের দপ্তরিকে মেরে মেরে আধমরা করেছে, বিষয়টা কেউই বিশ্বেস করেনি প্রথম। ভেবেছিলো অন্য কেস। কিন্তু ঐ যে বলে মেয়েতো নয়,যেনো একেকটা দস্যি মেয়ে।

"কি দপ্তরী বাবু তুমাকে কেনো ওরা এতো মার দিলো?"

জবাবে কেঁদেকেটে দপ্তরি ছেলেটা বললো,
"আমি ওদের গাছে চড়তে টিনের চালে উঠতে নিষেধ করেছিলাম"

তা এতো বড় নওজোয়ান দপ্তরি তুমি, অতোটুকুন দুটো মেয়ে তোমাকে কিভাবে  মারলো।

"আমিতো বুঝিনি, আমাকে বলেছিলো,

"এই দপ্তরী স্যার, কানা মাছি খেলবা আমাদের সাথে"।

আমি বললাম হ্যা।

তার পর দুই বোন ক্লাস রুমের দরজা লাগিয়ে আমার চোখ বানলো, হাত বানলো। তারপর পা। বললো নতুন কানামাছি খেলা।

তারপর?

"তারপর কি আবার, মাটিতে ফেলে চেয়ারের পা দিয়ে বাড়ির পর বাড়ি। আমাকে আধমরা করে,  জানালা দিয়ে দুবোন লাপাত্তা!!! স্যারেরা এসে আম আমাকে উদ্ধার না করলে মেরেই ফেলতো"

তা বাপু তোমার এতো কানামাছি খেলার স্বাধ জাগলো কেনো?

"আমি কি খেলতে চেয়েছি?
ওদের বললাম এই খবরদার গাছে চড়বানা, হেড স্যারের নিষেধ"
তারা বললো,
তাইলে কি করবো দপ্তরি স্যার।
আমি বললাম, ক্লাসে যাও, দস্যি কোথাকার, সারাদিন খালি দুষ্টামি।
তার পর দস্যি দুইটা বললো...

"আমাদের দস্যি বললা? আচ্ছা, তাইলে শুনো দপ্তরি স্যার, ক্লাসে যাবো যদি তুমি আমাদের সাথে আজ একটু সময় কানামছি খেলো। দুইজনেতো আর কানামাছি হয়না, তিনজন লাগে"

"আমি বুঝিনি ওরা যে কানামাছির কথা বলে দরজা লাগিয়ে আমাকে বেঁধে পিটাবে...."

এইকথা বলেই আবারো দপ্তরি র চোখের পানি নাকির পানি একাকার।

সালিশে সবাই বললো, যাও যাও দপ্তরী আর কেঁদোনা। কি আর করা। জ্বিনে ধরা মেয়ে গুলো। আমরা দেখছি কি করা যায়।

শালিসে দপ্তরির চিকিৎসার ভার পড়লো মেয়ে দুটির বাবার উপর। সেই সাথে স্কুল থেকে হাতে নগদ টিসি দিয়ে বিদায়।

কেবল গাছে চড়া আর চালে চড়াই নয়। মাঝেমাঝে কাউকে কি কিছু না বলে হঠাৎ করে দুই বোন উধাও। নাই নাই নাই। এ গ্রাম ওগ্রাম থানা পুলিশ কেউ কোন হদিস করতে পারেনা! মা বাবা সবাই কেঁদেকেটে শেষ না জনি কি দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।

পরদিন দেখা গেলো দুবোন হাজির। কি ব্যাপার কোথায় গিয়েছিলি বলেই প্রথম কিছুটা নগদ নারায়ণ  উত্তম মধ্যম। বাবাগো মাগো বলে কসম কেটে আর যাবোনা বলে রক্ষা। কিন্তু ঐ যে বলে চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। পরদিন আবার লাপাত্তা। এভাবে চলে যায় দিন।

এগুলো সাথে রয়েছের গ্রামবাসী'দের নানান জাতের অভিযোগ। কারো পাঁকা ধানে আগুন লাগিয়ে দেয়া। কারো ছাগল কে ট্রেনে তুলে দেয়া। সেদিন পাশের গ্রামের সিদ্দিক আলীর মুরগীর ফার্মে ঢুকে দশ টা মুরগী কে  জবাই করেছে দু বোন রোস্ট বানিয়ে খাবে। কিসের কি রোস্ট ঐ অবস্থায় রেখেই ভোঁ দৌড়। শুধু কি তাই, বনে জংগলে ঘুরে ঘুরে চুড়ুই, শালিক, ময়না শিকার করে ব্লেড দিয়ে কেটে মাটিতে পুতে ফেলা। কি নৃশংসতা, বর্বরতা!! মগ  আর বার্মিজ সেনাদের মতো মতো নৃশংসতা! অথচ দেখলে বুঝাই যায়না। কি নিষ্পাপ তাদের চাহুনী।

মা-বাবা সবাই অতিস্ট হয়ে এখন দুই বোনকে আলাদা ঘরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন। আর কতো। মান সম্মান সব গেলো।

দুই বোন কে আলাদা কেনো?

হ্যা আলাদাই। একসাথে রাখলে কিছুক্ষণ পরই দুজনে মারামারি শুরু করে। প্রচণ্ড মারামারি। নাক ফাটানো দাত ফাটানো কিছুই বাকি থাকেনা।

সেদিন গভীর রাতে হাতে পায়ের বাঁধ খুলে একজন উঠেছে নারিকেল গাছে। দুটো নারিকেল পেড়েছে। এই শেষ নয়। দাঁত দিয়ে নারিকেল দুটো ছিলেছে আর আরেকজন করেছে কি, ঘরে রাখা কচুর মুকি দাঁত দিয়ে কুচু কুচি করে চিবিয়েছে। এর পর বলপেন থেকে কালো কালি বের করে সারা মুখে লাগিয়ে কালো ভুত সেজেছে!! গভীর রাতে তাদের মা উঠে কুচকুচে কালো মুখ দেখেতো ভয়  পেয়ে চিৎকার । শুধু তাই নয় তাদের কান্ড দেখে সবার মুর্ছা যাবার অবস্থা। পরে সবাই মিলে শক্ত করে শিকল দিয়ে আলাদা ঘরে দুজন কে বেঁধে রাখেন।

আমি বললাম, কি মেয়েরা তোমরা কি এগুলো করো?

দুজনই মুচকি হাসে মাথা নেড়ে বলে "না"।
তাহলে কে করে অসব।
লোপা ইশারা করে ত্রপা কে, ত্রপা করে লোপাকে।
আচ্ছা দাঁত দিয়ে নারিকেল ছোলাও, কাচা কচুর মুল চিবাও তোমাদের দাঁতে ব্যাথা হয় না? মুখে চুলকায় না।
দুজনে দাঁত কেলিয়ে হেসে দাঁত দেখায়, আমাদের কিছু হয়না।
বলকি? সত্যি?
তিন সত্যি, এক সত্যি দুই সত্যি তিন সত্যি।
হুম বুঝলাম। আচ্চা তোমরা কি এগুলো নিজে থেকে করো না কেউ তোমাদের বলে এসব করতে?
আমরা নিজে থেকেই করি।

মাকে বললাম,ডাক্তার দেখিয়েছেন ওদের ?
হ্যা অনেক। এই যে।

আমি দেখলাম বেশ ক'জন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছেন।
সবার ই একি উপদেশ। একি ঔষধ। কিন্তু কোন ফল নেই। ক'দিন একটু নরম চরম। পরে যেই সেই।

এর কথা ওর কথায় নানান মোল্লা মুনসি, পীর দরবেশের কাছেও নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয় নি। উলটো এক পীর কে গরম তেলপড়া দিয়ে নাক মুখ জ্বালিয়ে ফেলেছে দস্যি দুটো।

কি ব্যাপার,পীর সাহেব কে কিভাবে গরম তেল দিয়ে পুড়িয়ে দিলো, গরম তেলই বা কোথায় পেলো ঐ দস্যি দুটো?
পীর বাবা গরম তেলে মরিচ পোড়া মিশিয়ে তাদের নাক আর কানের ভিতর ঢেলে দিতে চেয়েছিলো, জ্বীন তাড়াতে। তাদের নাকি জমজ জ্বীনে পেয়েছে। অতি খারাপ চরিত্রের দুটো কম বয়সী জমজ জ্বিন! জ্বীনের মধ্যে ও নাকি জমজ আছে। হুজুর যেইনা তেলের বাটি থেকে গরম তেল দু বোনের নাকে কানে ঢালবে, ঐ মুহুর্তে লাফ দিয়ে দু'বোন পুরো তেলের বাটি হাতে নিয়ে সবটুকুন গরম তেল ঢেলে দেয় পীরের নাকে মুখে তারপর ভোঁ দৌড়...। এদিকে পীর সাহেবের জীবন নিয়ে টানাটানি।
"হা হা হা তাই নাকি...", আমি হাসি আটকাতে পারলাম না।
সাথে সাথে দু বোন ও হি হি করে হেসে উঠলো।
একটা আরেকটার দিকে আংগুল দিয়ে ঈশারা করে বললো, আমি না ও ঢেলেছে...।
পাল্টা জন হাত থামিয়ে বললো, মিথ্যে, ওই আগে তেলের বাটি ছুড়ে মেরেছে হুজুরের মুখে।
শুধু কি তাই। গেলো শুক্রবার ছিলো তাদের খালাতো বোনের বিয়ে। সকাল থেকে দস্যি দূটো কেঁদেকেটে অস্থির, "মা বাঁধন খুলে দাও। আপুর বিয়েতে যাবো, আমরা আর দুষ্টুমি করবোনা। মা তোমার দোহাই দাওনা বাঁধন খুলে..."
ওদের কাকুতি মিনতি তে ওর বাবা বললো, আচ্ছা দাওনা বাঁধনটা খুলে। মেয়ে দুটো যখন এতো করে বলছে। বাঁধন খুলে দেই আমি। ওরা ওদের বাবার সাথে বিয়ে বাড়ি যায়। একদম ভালো। কোন দুষ্টুমি নেই। কিন্তু কাজী সাহেব যখন কবুল পড়াতে গেলেন তখন বাঁধালো গন্ডগোল পাঁজি দুটো। হঠাৎ উঠে গিয়ে কনে, মানে ওদের খালাতো বোনের ঘোমটা টা খুলে চুল ধরে দিলো হেচকা টান তার পর ভোঁ দৌড়। রাতে তাদের জিজ্ঞেস করলাম মারে তোরা এইটা কি করলি?ওদের নাকি খুব ক্ষিধে পেয়েছিলো আর কনে নাকি খামাখা কবুল বলতে দেরী করছিলো। তাদের মা বললো।
"হি হি হি, দিমুনা টান। আপুতো নিজেই সারাদিন সেঁজেগুঁজে বিয়েতে বসেছে আবার কবুল বলেনা। আমাদের কি ক্ষিধে পায়না"। পাশে বসে থাকা লোপা আর ত্রোপা মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দেয় জবাব।
আচ্চা তোমরা এসব কেনো করো পিচ্চিরা।?
"কই আমরাতো কিছু করিনা...."
মা বললেন,
"স্যার কি করবো? ওদের যন্ত্রনায়, দুঃখে মাঝেমধ্যে মনে হয় বিষ খেয়ে দুইটাকে মেরে ফেলি। কিন্তু পারিনা। দস্যি দুটো যখন গ্রামের ছেলে পুলেদের তাড়া খেয়ে দৌড়ে এসে মা মা মা বলে আমার বুকে এসে ঝাপটে লুকায় তখন আর কিছু করতে পারিনা। তখন কেবল চোখের জ্বল ফেলি। আল্লাহ যে কি পরীক্ষায় আমায় ফেললেন! স্যার মেয়ে গুলো কি ভালো হবেনা? সত্যি কি ওদের জ্বীনে ধরেছে....."?
"না ওদের জ্বীনে ধরেনি। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ"
মানসিক রোগ?
হ্যা।
স্যার তাহলে কি ভালো হবেনা কোনদিন?
হ্যা ভালো হবে তবে পুরোপুরি হবেনা। অনেক রোগই'তো আছে পুরোপুরি সারেনা। সবসময় ওষুধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণ এ রাখতে হয়। । যেমন ডায়াবেটিস প্রেসার। ইত্যাদি। আপনার দস্যি মেয়ে দুটোর ও সে রকম ব্রেইনের একটি রোগ হয়েছে। ওষুধ খাওয়ান, ধৈর্য ধরেন। আর আপাতত ওদের একটু আটকে রাখেন দুটো দিন। না হলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আর না হয় হাসপাতালে ভর্তি রাখেন কটা দিন। ওরা সুস্থ হয়ে যাবে।
আরেকটি কথা শিকল, রশি, ব্রেসলেট , মালা ইত্যাদি দিয়ে বেঁধে রাখলে ব্রেইনের রোগ ভালো হয়না। এতে ভালোর চেয়ে খারাপ হবার সম্ভাবনাই বাড়ে। যদি বেঁধে বা আটকে রাখতেই হয় তবে দড়ি বা শিকল নয় সুতি কাপড় ব্যবহার উচিৎ।
মেয়েদুটো দুস্টুমি করেই চলেছে চেম্বারে বসে বসে। তাদের কচি হাঁত গুলো বাঁধা রশি দিয়ে। কালচে দাগ পড়ে আছে।



'' দস্যি মেয়ে '' - ডা. সাঈদ এনাম
ডা. সাঈদ এনাম

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম । 
এম.বি.বি.এস (ডি এম সি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) সাইকিয়াট্রিস্ট
 ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।

Post a Comment

Previous Post Next Post