বন্যায় চলাচল অনুপযোগী হাজার কিলোমিটার সড়ক

অনলাইন ডেস্কঃ দু’দফা বন্যায় সিলেট বিভাগের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক সড়ক এখনো পানির নিচে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গত ৭ জুলাই সিলেট বিভাগের সওজ ও এলজিইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও তা মেরামতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার হিসাব এরই মধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু হবে। একাধিক কর্মকর্তা জানান, অধিক ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো মাস দু-একের মধ্যে সংস্কার করা হবে। বাকিগুলোর কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে শুরু হবে।

গত মার্চের শেষ দিকে হাওড় এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেই বন্যার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই জুন থেকে সিলেট বিভাগের অনেক স্থানে বন্যা হয়। এখনো সিলেট ও মৌলভীবাজারের অন্তত আটটি উপজেলা পানিতে তলিয়ে আছে। বিদত্সীমার উপরে রয়েছে এলাকার প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পানি।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের হিসাবে, গত মাসে সিলেটে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ১ জুন থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ৯৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।

এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে অনেক সড়কের কার্পেটিং উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সড়কের দু’পাশে ধসে গেছে অথবা ভেঙে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এলজিইডির আওতাধীন গ্রামীণ সড়কগুলো। কেবল সিলেট জেলায় এলজিইডির আওতাধীন প্রায় ২১৭ কিলোমিটার পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঁচা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৫৪ কিলোমিটার। এলজিইডির আওতাধীন সিলেট জেলার ক্ষতিগ্রস্ত পাকা সড়কগুলো মেরামতে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

সিলেট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এএসএম মহসিন বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৪৯ কিলোমিটার সড়ক। এছাড়া বালাগঞ্জে ৪০ কিলোমিটার, সদরে ৩৫ কিলোমিটার, গোয়াইনঘাটে প্রায় ৩১ কিলোমিটার, গোলাপগঞ্জে ২২ কিলোমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৫ কিলোমিটারসহ অন্যান্য উপজেলায় আরো কিছু সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে সংস্কারকাজ শুরু হবে।

সিলেট বিভাগে সওজের অধীন মোট ১ হাজার ৪০৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে; এর মধ্যে বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে ২৫০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় তিনটি করে সড়ক বন্যায় বেশ কয়েক দিন ধরে প্লাবিত রয়েছে। এ সড়কগুলোর ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ সম্ভব না হলেও তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই দুই জেলা মিলে বিচ্ছিন্নভাবে সাড়ে নয় কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন জায়গায় প্লাবিত হয়েছে। হবিগঞ্জে বন্যা না হলেও পাহাড়ি ঢলে একটি সড়ক ভেঙে গেছে, সুনামগঞ্জে বৃষ্টির পাশাপাশি হাওড়ের পানির ঢেউয়েও রাস্তার ক্ষতি হয়েছে।

চলতি বন্যায় সিলেট জেলায় সওজের অধীন দুটি উপজেলার তিনটি সড়কে ছয় কিলোমিটার প্লাবিত হয়। সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের চারখাই থেকে বিয়ানীবাজার পর্যন্ত প্লাবিত হয়ে এক সপ্তাহের মতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। একইভাবে ফেঞ্চুগঞ্জ-মাইজগাঁও-পালপুর সড়কের বিভিন্ন জায়গা এখনো পানিতে নিমজ্জিত। ভাদেশ্বর-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কটিও বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সওজের সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী উত্পল সামন্ত বলেন, কিছু সড়ক প্লাবিত হওয়া ছাড়া বন্যায় সওজের আওতাধীন রাস্তাঘাটের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে বেশি ক্ষতি হয়েছে অতিবৃষ্টিতে। এতে পুরো জেলায় সওজের ৫৪৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে অন্তত ১৫০ কিলোমিটারে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

মৌলভীবাজারে বন্যায় রাজনগর থেকে কুলাউড়া, জুড়ী হয়ে বড়লেখা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার সড়ক প্লাবিত হয়। উপজেলার হিসাবে জুড়ীতে বেশি রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। এর মধ্যে জুড়ী-ফুলতলা-বটুলি সড়কে দশমিক ৪ কিলোমিটার এবং জুড়ী-লাঠিটিলা সড়কে দশমিক ৩ কিলোমিটার জায়গা প্লাবিত হয়। এ রাস্তাগুলোর বেশকিছু জায়গা এখনো পানির নিচে বলে জানান মৌলভীবাজার সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মিন্টু রঞ্জন দেবনাথ।

তিনি বলেন, বন্যায় পুরো জেলায় অন্তত সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে সবমিলে ৬০-৭০ কিলোমিটার সড়কে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। শেরপুর-আউশকান্দি সড়কের দুই কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ জেলায় সওজের অধীনে ৩০০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে।

গত মার্চ-এপ্রিলে অকাল বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর সংস্কার করার আগে চলতি বৃষ্টিপাত ও হাওড়ের পানির ঢেউয়ে সুনামগঞ্জে আরো ৩০ কিলোমিটারের মতো সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম। পুরো জেলায় তাদের সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে বলে জানান তিনি।

একইভাবে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জে সওজের কিছু রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন হবিগঞ্জ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীম আল মামুন। তিনি বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে পাহাড়ি ঢলে চুনারুঘাট উপজেলায় ৪০-৪৫ মিটার সড়ক ভেঙে গেছে। অতিবৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা মেরামত করে নেয়া হচ্ছে। এ জেলায় ২১০ কিলোমিটার সড়ক তাদের আওতাধীন বলে জানান তিনি।

মৌলভীবাজারে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম বলেন, জেলায় ১৫শ কিলোমিটার পাকা রাস্তা রয়েছে; যার অনেকগুলো চলতি বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বড়লেখা উপজেলায় ৩০ শতাংশ, জুড়ীতে ২৫ শতাংশ এবং কুলাউড়ায় ২০ শতাংশ রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এতে বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, গত মার্চ-এপ্রিলে আগাম বন্যায় পুরো জেলায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করছি।

সুনামগঞ্জে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মার্চ-এপ্রিলে সুনামগঞ্জে অকাল বন্যার জন্য গত অর্থবছরের কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সে সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করার আগেই চলতি মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে নতুন করে রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুরো জেলায় তাদের অধীন ১ হাজার ৩৮০ কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে বলে জানান তিনি।

হবিগঞ্জে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ আবু জাকির সেকান্দার বলেন, পুরো জেলায় এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পাকা সড়ক রয়েছে। অতিবৃষ্টিতে কী পরিমাণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা এখনো হিসাব করা হয়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। প্রতি বছর সাধারণত ১০০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এবার বরাদ্দ বেড়েছে। গত বছর ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, এবার ১৭ কোটি হয়েছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post