হাকালুকিতে বেড়েছে পোনামাছ পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য

ইমাদ উদ দীন: রাতের আঁধারেই পোনামাছ ধরা আর কেনাবেচা। এখন পুরো হাওরজুড়ে চলছে এমন রমরমা ব্যবসা। দিন দিন বেড়ে চলেছে পাচারকারীদের এমন দৌরাত্ম্য। এশিয়ার অন্যতম ও দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে এখন অবাধে চলছে দেশীয় প্রজাতির পোনামাছ নিধন। প্রতিদিনই অবাধে পোনামাছ নিধনের কারণে দেশের মিঠা পানির মৎস্যভাণ্ডারখ্যাত হাকালুকির মৎস্যসম্পদ এখন হুমকির মুখে।
এ বছর এমনিতে চৈত্রের অকাল বন্যায় আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বির্পযস্ত হাওর। দেশীয় প্রজাতির মাছের মড়কে মাছের আকাল। চৈত্রের বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বোরো ধান পচে সৃষ্ট বিষক্রিয়ায় মাছ, জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদ মারা যাওয়ার পর আরো ২ দফা বন্যা। প্রথম দফা বন্যায় ক্ষতি হলেও এর পরপর দুটি বন্যায় হাওর তীরবর্তী শতাধিক গ্রামের পুকুর, জলাশয় ও মৎস্যখামার পানিতে তলিয়ে যায়। আর ওই সব দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎসস্থলগুলো থেকে পানির থোড়ে ওখানকার মাছগুলো ভেসে হাওরে আসে। ফলে হাওরের দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট অনেকটাই কেটে ওঠে।
সরকারি উদ্যোগেও হাওরে অবমুক্ত করা হয় মাছের পোনা। পুকুর, জলাশয়, মৎস্য খামার আর নদী ও খাল থেকে বানের পানিতে ভেসে আসা মাছগুলোও হাওরে পোনা ছাড়তে শুরু করে। সব মিলিয়ে হাকালুকিতে অনেকটা মাছের সংকট কাটিয়ে ওঠার অবস্থা সৃষ্টি হয়। আর এই সুবাদে তৎপর হয়ে উঠে একটি চক্র। তারা বেশি লাভের আশায় পোনা মাছ নিধনে মরিয়া হয়ে ওঠে। সংঘবদ্ধভাবে তারা তৎপর হয়ে ওঠে পোনা মাছ নিধনে। 
জানা যায়, অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহায়তায় পাচারকারীরা প্রতিদিনই দুই থেকে তিন টন পোনামাছ পাচার করে বিক্রি করছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। প্রশাসনের উদাসীনতায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ৩য় দফার চলমান বন্যায় তলিয়ে গেছে হাকালুকির সবকটি জলমহাল। স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন স্থানীয় দরিদ্র মৎস্যজীবীদের দিয়ে হাওরে বেড়াজাল, কারেন্ট জাল ও কাপড়ি জাল দিয়ে মাছ শিকার করান। এসব জালে আটকা পড়ছে বিভিন্ন জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা। 
হাকালুকি হাওর থেকে পোনা মাছ শিকার করে রাত ১০টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত কুলাউড়া উপজেলার ভূকশীমইলের নবাবগঞ্জ বাজার, তেঘরীঘাট ও জুড়ী উপজেলার আশুরিঘাট, মানুসিং (কাটানালির পাড়) ও কন্টিনালা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শিকারিরা তা বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের নির্দিষ্ট বিভিন্ন বড় বড় শহরের পাইকারদের কাছে নিলামে বিক্রি করেন। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ এসব পোনামাছ ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে যান সিলেট, হবিগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২৩ সেন্টিমিটারের (৯ ইঞ্চি) চেয়ে কম মাপের শোল, রুই, কাতলা, মৃগেল, কালীবাউশ, আইড় এবং বোয়ালসহ সব ধরনের পোনামাছ ধরা, বিক্রি এবং বেড়জালসহ ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের কম ব্যাসার্ধের ফাঁকবিশিষ্ট জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এসময় জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় ও দারিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীরা তাদের দিয়ে পোনামাছ শিকার করান। এমনটিই জানালেন হাওর তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার সাদিপুর, মিরশংকর ও জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও ও শাহপুরের মৎস্যজীবী লোকজন।
এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন, আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে পোনামাছ ও জাল জব্দ এবং জরিমানা করেছি। গভীর রাতে অভিযান পরিচালনা করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে সময়মতো তিনটি ডিপার্টমেন্টকে এক করা যায় না। বিশেষ করে পুলিশ ফোর্স সময়মতো পাওয়া যায় না। তবে কয়েকবার রাতে অভিযানে নেমেছিলাম, কিন্তু পাচারকারীরা অভিযানের খবর পেয়ে সটকে পড়ে তাই তাদের ধরা যায় না। এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল কদ্দুস আকন্দ বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পোনামাছ নিধনে সক্রিয় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকটি অভিযানও চালিয়েছি। আমাদের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ওই সময়ে যাতে মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থান হয় সেজন্য খাঁচায় মাছচাষসহ নানা উদ্যোগ ও উদ্ভাবন নিয়ে এগিয়ে আসছে মৎস্য বিভাগ। তিনি দেশীয় মৎস্যসম্পদ রক্ষায় সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।

Post a Comment

Previous Post Next Post