অনলাইন ডেস্কঃ চা বাগান, উঁচু-নিচু পাহাড় ও টিলাঘেরা সিলেট নগরী একসময় পরিচিত ছিল সবুজ শহর হিসেবে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে গত ২১ বছরে সিলেট নগরের গাছপালা (সবুজ) কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ওই সময়ের মধ্যে ব্যাপক হারে কমেছে উন্মুক্ত জমি ও জলাশয়। আর প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বহুতল ভবন। সম্প্রতি এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত ২১ বছরের গুগলের স্যাটেলাইট ইমেজের ওপর ভিত্তি করে জিআইএস ও রিমোট সেন্সিংভিত্তিক হাইব্রিড ইমেজ ক্লাসিফিকেশন টেকনিকের মাধ্যমে এ গবেষণা পরিচালনা করেন জিআইএস ও আরএস বিশ্লেষক সঞ্জয় রায়। গবেষণায় সবুজ বলতে গাছপালা ও ঘাসকে বোঝানো হয়েছে।
গবেষণায় সবুজ, জলাভূমি ও উন্মুক্ত জমি কমে যাওয়ার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে গাছপালা কেটে যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মাণ, পাহাড়-টিলা কাটা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন সঞ্জয় রায়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরে সিলেট নগরী সবুজহীন হয়ে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সঞ্জয় রায় বলেন, ‘সিলেট খুব দ্রুত বর্ধনশীল শহর। এ শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এজন্য পাহাড়-টিলা ধ্বংস করে ও গাছপালা কেটে কেবল ইট-কাঠের ভবন গড়ে উঠছে। নগরায়ণের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা মানা
হচ্ছে না। এতে নগরের পরিবেশ ও সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সবুজ কমে যাওয়ার কারণে সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসবে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, গরম বাড়বে। শহরের জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে মানুষের মনস্তত্ত্বেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।’
গবেষণায় দেখা যায়, নগরীর ২ হাজার ৭১৩ দশমিক ৭৭ হেক্টর ভূমির মধ্যে ১৯৯৫ সালে সবুজ ভূমি ছিল ১ হাজার ৩৪৭ দশমিক শূন্য ৩ হেক্টর, যা মোট ভূমির ৪৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০০৫ সালে সবুজ
ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৬ দশমিক ২০ হেক্টর, যা মোট ভূমির ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে এসে নগরের সবুজ ভূমির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬৭৩ দশমিক ২৯ হেক্টর, যা মোট ভূমির মাত্র ২৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
এ গবেষণায় ১৯৯৫-২০১৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে সিলেট নগরের সবুজ ভূমি ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া ১৯৯৫ সালে সিলেট নগরের উন্মুক্ত ভূমি ছিল ২৯৭ হেক্টর, ২০১৬ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২৫ দশমিক ৮২ হেক্টরে, যা মোট ভূমির মাত্র ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অন্যদিকে, সিলেট নগরে জলাভূমি ছিল ১৪৩ দশমিক ২৮ হেক্টর, ২০১৬ সালে যা কমে এসেছে ১১৬ দশমিক ১৯ হেক্টরে, যা মোট ভূমির মাত্র ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। ওই সময়ের মধ্যে নগরীতে গড়ে উঠেছে একের পর এক ভবন। গবেষণার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে নগরীতে ৯২৬ দশমিক ৪৬ হেক্টর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় ভবন, যা মোট জমির ৩৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৯৮ দশমিক ৪৭ হেক্টরে, যা মোট জমির ৬৬ দশমিক ২৭ শতাংশ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই সিলেট নগরীর পাহাড়-টিলা ও গাছপালা কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া থামানো যাচ্ছে না। তিনি সিলেট নগরীর ভেতরের পুরনো কারাগারের জায়গায় উন্মুক্ত উদ্যান করার দাবি জানান। এছাড়া বৃক্ষ নিধন ও পাহাড়-টিলা কর্তনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি তার।’
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম নগরীর সবুজ কমে যাওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই এমনটি হচ্ছে। এতে নগরের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর স্বল্পমেয়াদি প্রভাব পরিলিক্ষিত না হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।’
এখনো সিলেট নগরীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোলো এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ‘সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন একটি মাস্টার প্ল্যানও হাতে নিয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর নগরীতে ১০ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।’ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে বলে মনে করেন তিনি। সুত্রঃ সিলেটটুডে