" একটি দুঃস্বপ্ন " - জ্যোৎস্না খান

" একটি দুঃস্বপ্ন " - জ্যোৎস্না খান
জ্যোৎস্না খান: অনেকগুলো বাৎসরিক ছুটি জমা হয়ে যাওয়াতে গত কদিন ধরে ছুটি নিয়ে বাসাতে বিশ্রাম নিচ্ছি। কিন্তু বহু বছরের কাজের অভ্যাস, কদিন বিশ্রাম নিয়েই যেন হাঁপিয়ে উঠেছি।

বেশ রাত হয়ে গেছে। বাচ্চারা যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে। আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুম আসছে না। তাই বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে আকাশটাকে দেখার ইচ্ছা হল। অলস পায়ে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে আকাশপানে তাকালাম। অন্ধকার রাত। তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু আনমনা হয়ে ঐ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ গার্ডেনের ফ্লড লাইটটা জ্বলে উঠতেই চমকে উঠলাম। গার্ডেন লাইটের আলোতে দেখলাম একটি শিয়াল গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছে। শিয়ালকে দেখে আমার মনে কয়েকটা প্রশ্নের উদ্রেগ হল, শিয়ালটা কোথা থেকে এলো ? গার্ডেনে ঢুকলোইবা কিভাবে ? অবশ্য আমাদের বাসার অনতিদূরে একটি বড় পার্ক আছে। সেখানে অনেক ঝুপঝাড় ও জঙ্গল আছে। হয়ত সেখান থেকে এসেছে। পার্কের ঝুপঝাড় অথবা জঙ্গলেই হয়ত তার বাস। গার্ডেনের লোহার গেইটের নিচে সামান্য ফাঁক থাকায় সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। জানালা খুলে দু'তলা থেকে ধ্যাৎ ধ্যাৎ বলে শেয়ালটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। সে আমার দিকে কয়েকবার তাকালো এরপর আস্তে আস্তে চলে গেল। তৎক্ষণাত আমার একটি গল্প মনে পড়ল তাই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম।

নিরব নিস্তব্ধ রাত। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। বাজার ভেঙ্গেছে অনেক আগেই। একা পথে হাঁটছে পথিক, সঙ্গী সাথী কেউ নেই। বাজার থেকে বের হয়ে রেললাইনটা পেরিয়ে মেঠোপথে পা রেখেছে। গাঁয়ের মেঠোপথে বিদ্যুৎ বাতির আলোও নেই। অন্ধকারে অনেকটা আন্দাজ করে পথ চলা। মনের মধ্যে কিছুটা ভয়ও কাজ করছে। একজন সঙ্গী পাওয়া গেলে ভাল হত কিন্তু এতরাতে সঙ্গী পাবে কোথায় ? গ্রামের লোকজন সদাই শেষ করে অনেক আগেই যার যার বাড়ি চলে গেছে। অন্যদিন সে-ও সন্ধ্যার পরপরই সবকাজ শেষ করে বাড়ি চলে যায়। তখন পথ চলতে অনেক লোকজন পাওয়া যায়। কথা বলতে বলতে পথও চলা যায়। কারো হাতে থাকে হারিকেন, আবার কারো হাতে টর্চলাইট। কেউ কেউ আবার গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে। কয়েকজন একসাথে পথ চলার আনন্দটাই আলাদা।
আজ সে একটা বিশেষ কাজে আটকা পড়াতে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। পথিকের বাড়িতে আসা-যাওয়ার একটিই রাস্তা । ডানে বাঁয়ে অন্য কোন রাস্তা নেই । একই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন আসা যাওয়া। তাই পথ চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু চারিদিকের অন্ধকার নিস্তব্ধ নিরবতা মনের মধ্যে খানিকটা ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ ঘৈউ। আবার কখনও হুতুম পেঁচার ডাকে শরীর শিউরে উঠে। রাস্তার দু'পাশে বিস্তৃত ধান ক্ষেত, মাঝেমাঝে রাস্তার গা ঘেসে বড় বড় গাছ। বাতাস না থাকায় গাছগুলো কেমন ঝিম ধরে আছে।
পথিক মাঝে মাঝে চোখ তুলে ঐ দূর আকাশের দিকে তাকায় আর ভাবে যদি আকাশে আজ চাঁদটা উঠতো তা'হলে রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যেতো, স্বাচ্ছন্দ্য মনে রাস্তাটা অতিক্রম করে বাড়ি পৌঁছতে পারতো। কিন্তু চাঁদ মামাতো এখন ঘুমিয়ে আছে, তাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলা কি সম্ভব ?
একটু সামনে রাস্তার দু'পাশে বেশ বড় দু'টি বাঁশ ঝাঁড়। বাঁশ ঝাঁড়ের একপাশে অনেক পুরানো একটি শ্মশান। ঐ জায়গাটা বেশ ভয়ঙ্কর ! আর এই বাঁশঝাঁড়কে ঘিরে অনেক ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গল্প কাহিনী রয়েছে।
যেমন গভীর রাতে বাঁশ ঝাঁড়ের মাথায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। দূর থেকে অনেকেই সেই দৃশ্য দেখেছেন কিন্তু কাছে গিয়ে দেখার মত দুঃসাহস কেউ করেননি। আবার কখনও রাতের বেলা কেউ যদি ঐদিকটায় যায় তবে দু'একটি বাঁশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় কাছে যাওয়ার সাথে সাথে তড়িৎ গতিতে বাঁশগুলো সুঁজা হয়ে দাঁড়ায়। এ দৃশ্য দেখে অনেকেই ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়েছেন বলেও শুনা যায়। অমাবশ্যা কিংবা ঘন কালো অন্ধকার রাতে নারী কন্ঠের কান্নার শব্দ ভেসে আসতে অনেকেই শুনেছেন। অনেকেই আবার এসব রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অত্র এলাকায় ছোট বাচ্চারা কাঁদলে বা কথা না শুনলে ঐ বাঁশ ঝাঁড়ের কথা বলে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানো হয়। এই ভয়ঙ্কর বাঁশ ঝাঁড়ের গল্প আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের মুখে মুখে থাকে। তাই রাতের বেলা ঐ পথে চলতে গেলে সবাই সঙ্গী খুঁজে নেয়। কয়েকজন একসাথে থাকলে অন্তত কিছুটা নির্ভয়ে পথ চলা সম্ভব।

ভীষণ ভয় লাগছে । আজ বুঝি তার ভাগ্যটাই খারাপ! না কোনো লোকজন মিলছে, না চাঁদের দেখা। প্রকৃতিটা যেন বৈরী হয়ে আছে। কিভাবে যে বাঁশ ঝাঁড়টা পাশ কেটে যাবে ভেবে পাচ্ছে না। পথিক যতই সামনের দিকে এগুচ্ছে বাঁশ ঝাঁড়টাও যেন আরো দ্রুত গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মনের অজান্তেই তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করছে। পথিক কাঁপা-কাঁপা স্বরে স্বশব্দে দোআ দুরুদ পড়তে শুরু করলো।
হঠাৎ একটু দূরে নিভু নিভু আলোর রশ্মি চোঁখে পড়তে মনের মধ্যে খানিকটা সাহসের উদ্রেগ হলো। ভাবলো সম্ভবত কেউ হারিকেন হাতে নিয়ে ওদিকটায় যাচ্ছে। সাথে সাথে একটু চিন্তিত হলো, এতক্ষণ যাবৎতো কাউকে হারিকেন হাতে যেতে চোঁখে পড়লো না, হঠাৎ করে হারিকেন ওয়ালা এলো কোত্থেকে ? একি কোন ভূত-পেত্মী বা অশরীরী আত্মার কোন কারসাজি ? কিন্তু না ভূত-পেত্মীর হাতে তো আগুন থাকার কথা না। নিশ্চয়ই কোন মানুষ হবে। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে হয়তো রাস্তার পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এখন আবার উঠে দাঁড়িয়ে হারিকেন হাতে পথ চলা শুরু করেছে। যাই হোক ভালই হল অবশেষে একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। কথা বলতে বলতে বাকী পথটা চলা যাবে একসাথে। হারিকেনের আলোতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন পথটাও দেখে চলতে সুবিধা হবে।
পথিক এবার লোকটাকে পিছন থেকে ডাকল- "হারিকেন হাতে কে যাচ্ছেন, একটু থামেন, আমাকে একটু আলো দেখিয়ে আপনার সাথে নিয়ে যান"। পথিকের ডাকে লোকটা পিছন ফিরে তাকালো কিন্তু মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল না। লোকটা তড়িৎ গতিতে ঘুরে আরো দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করলো। এবার পথিক ভাবতে লাগলো আশ্চর্যতো ! লোকটি পিছন ফিরে তাকালো এখন আবার দ্রুত গতিতে হাঁটছে কেন? পথিক আবারও পিছন থেকে আওয়াজ দিল কিন্তু লোকটি আর পিছন ফিরে দিকে তাকাল না, দ্রুত হাঁটতে থাকল। পথিকও তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল, দ্রুত হেঁটে লোকটার কাছাকাছি পৌঁছার চেষ্টা কিন্তু কিছুতেই কাছে পৌঁছতে পারছে না। পথিক যতই দ্রুত হাঁটছে লোকটা তারচেয়ে দ্বিগুণ গতিতে হাঁটছে। এবার পথিক দৌড়ে লোকটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে লোকটাও তখন দৌড়াতে শুরু করে। এবার শুরু হলো যেন দু'জনের দৌড়ের প্রতিযোগিতা। পথিকের চেষ্টা লোকটার কাছে যাওয়া আর লোকটার চেষ্টা পথিকের নাগালের বাইরে থাকা।

একটু সামনে রাস্তার মোড়ে ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর আর কুঁড়ে ঘুরের একপাশে আকাশ ছোঁয়া একটি তালগাছ। ঘরের ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না বা কোনো বাতিও জ্বলতে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে পৌঁছতেই লোকটা উধাও। আশ্চর্যতো কোথায় গেল লোকটা ! একটু আগেইতো লোকটাকে প্রাণপণে দৌড়াতে দেখলাম। পথিক চারিদিকে তাকালো কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। লোকটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে পথিকের মনে অনেক না জানা প্রশ্নের উদ্রেগ হল এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তালগাছটার নীচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ কটকট শব্দে স্বম্ভিৎ ফিরে পেল। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে একটি কালো ঘোড়া তার দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। ঘোড়ার উপরে কালো পোশাক পরিহিতা এলোকেশি এক যুবতী বসে লাগাম ধরে আছে। ঘোড়া ও যুবতীর চোখগুলো যেন একেকটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। আর জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির নির্গত লাভা থেকে নিসৃত আগুনের স্ফুলিঙ্গগুলি তার চারিদিক ছেঁয়ে ফেলেছে। পালাবার সব দ্বার রুদ্ধ দেখে পথিক ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে নিজেকে নিজ ঘরের বিছানায় আবিষ্কার করল। পরিবারের সবাই তাকে ঘিরে আছে, কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না সে কি জীবিত না মৃত নাকি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো !!

Post a Comment

Previous Post Next Post