ত্রাণে পেট ভরে না স্থায়ী সমাধান চাই

ত্রাণে পেট ভরে না স্থায়ী সমাধান চাই
ইমাদ উদ দীন, হাকালুকি হাওর থেকে ফিরে: বছর বছর ফসল হারিয়ে আর কত আর্তনাদ আর আহাজারি? একটু ত্রাণের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আর কত যুদ্ধ করবো। এমন ত্রাণে পেটও ভরে না। আর চাহিদানুযায়ী অপ্রতুল ত্রাণ বাড়ানোর আবদারও করতে চাই না।
সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি। এমন বির্পযয় থেকে আমাদের স্থায়ী মুক্তি দিন। আমরা ত্রাণ নিতে চাইনা। আমাদের পরিশ্রমের সোনালী ফসল ঘরে তুলতে চাই। আমরা ভিখারী হতে নয়, আমাদের অন্ন দিয়ে অন্যের সহযোগী হতে চাই। আমরাও দেশের উন্নয়ন কর্মী হতে চাই। গতকাল হাকালুকি হাওরে গেলে এমন দাবি তোলেন হাওর পাড়ের বাসিন্দা ছত্তার মিয়া (৫৫), আবুল হোসেন (৫০), তাহির মিয়া (৬০), ইসমেত মিয়া (৩৮), জুনেদ আহমদ (৪৮), গণেশ চন্দ (৫৮), গোপী শীল (৬২), বাতির মিয়া (৪৮), রোমান আহমদ (১৮), গোলবান বিবি (৬২), রেণু বেগম (৪৫), লীলামতি বেগম (৪৮) গুলজার মিয়া (৬৮)সহ অনেকেই। 

এদের মধ্যে অসুস্থ বৃদ্ধ গুলজারের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১২ জন। এদের মধ্যে ৮ জনই শিশু। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনি। মাথা গোঁজার ঠাঁই বাঁশের বেড়ার যে ঘরটি তাও নড়বড়ে। জরাজীর্ণ নিজ ঘরের বারান্দায় চোখের জলে জীবন সায়াহ্নে এসে সরকারের কাছে এমন মানবিক আবেদন জানান তিনি। তার অসহায়ত্বের কথায় সায় দিয়ে দুর্ভোগগ্রস্ত অন্যরাও অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমাদের দুর্দশার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে জানান। অন্যদের অনেক বলেছি আর বলতে চাই না। দু’চোখের জলে সরল বিশ্বাসে তাদের এমন চরম অসহয়াত্বের কথাগুলো দেশের সরকার প্রধানের কাছে খবর পৌঁছানোর নিশ্চয়তায় একনাগাড়েই বলছিলেন তারা। হঠাৎ দুর্যোগে বিপর্যস্ত পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে থাকা লোকগুলোর এমন বাস্তবিক করুণ দৃশ্যে দু’চোখের অশ্রু সংবরণ করা কষ্টকর। 
দুর্ভোগগ্রস্ত এই লোকগুলো হাকালুকি হাওর তীরের সাদীপুর ও মীরশংকর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় মৎস্য ও কৃষিজীবী। এ বছর পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে তাদের সোনালী স্বপ্নের মৃত্যু। ধান নেই, মাছও নেই। তাই হাকালুকির তীরজুড়ে হাহাকার। অভাবের তাড়না আর খাদ্য ও বাসস্থান সংকটে বিক্রি করছেন গবাদি পশু। একে একে বেঁচে থাকার সব উপকরণই এখন হাত ছাড়া হচ্ছে। সব হারিয়ে নিঃস্ব কর্মহীন হাকালুকির জেলে ও চাষীরা খাওয়া বাঁচার চিন্তায় দিশাহারা। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বাঁশের বেড়ার জরাজীর্ণ বসতঘরের জনবহুল পরিবারের এসব বাসিন্দার বিশুদ্ধ খাবার পানি আর স্যানিটেশন এখন চরম সংকট। জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই। তাই প্রতিটি পরিবারে পাশাপাশি দূরত্বে থাকা শিশু ৮-১০জন। ১৫-২০ জনের পরিবারে উপার্জনক্ষম একজন কিংবা দু’জন। এমন দৃশ্য পুরো গ্রামে। জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম মাছ ধরা আর ধান চাষ। এ বছর সব হারিয়ে এখন তারা নির্বাক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, হাকালুকির আয়তন প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর। এটি দেশের বৃহত্তম হাওর। মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ৫টি উপজেলা জুড়ে ২৩৮ বিলের এই হাওরটির অবস্থান। এ বছর চৈত্র মাসে টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা অংশে পানিতে তলিয়ে যায় প্রায় শত কোটি টাকার (থোড়ওয়ালা ও আধা-পাকা) বোরো ধান। ক্ষতিগ্রস্ত হন লক্ষাধিক কৃষক ও মৎস্যজীবী। পানিতে তলিয়ে যাওয়া বোরো ধান পচে পানি দূষিত হয়ে মারা যায় ২৫ মেট্রিকটন দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা ও পোনামাছ। মারা যায় হাঁস, সাপ, ব্যঙ, শামুক, জোঁকসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী। 
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান এর আগে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে এ রকম আগাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের বোরো ধান তলিয়ে গিয়েছিল। হাওরের বিভিন্ন এলাকা প্রায় ছয় মাস জলাবদ্ধ ছিল। তখন ধান হারালেও এবারের মতো মাছ, হাঁস কিংবা জলজ প্রাণীর এত ব্যাপক ক্ষতি হয়নি।
জানা যায়, হাওরটির ফসল রক্ষায় ১৯৮২ সালের দিকে পাউবো একটি সেচ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন হাওরের মাছ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণ দেখিয়ে পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা আপত্তি জানালে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। হাওর পাড়ের বাসিন্দাদের দাবি ফসল রক্ষায় নাব্যতা হ্রাস হয়ে যাওয়া হাওরের বিল-নদী ও খাল পুনঃখনন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, হাওরের বিল (জলমহাল) ইজারা প্রথা বাতিল, দেশীয় বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ রক্ষায় বিলগুলোকে দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা। বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হাকালুকি হাওরকে পর্যটন শিল্পের আওতায় এনে তার যথাযথ উন্নয়ন ও রাজস্ব আয়ের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
জানা যায়, দেশের ৩৭৩টি হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকার সমন্বিত উন্নয়নের জন্য ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করে সরকার। ২০১২-১৩ অর্থবছর হতে ২০ বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সম্বলিত ‘হাওর মহাপরিকল্পনা’ প্রণয়ন করা হয়। এ মহাপরিকল্পনায় মোট ১৫৩টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার কোন হাওরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। চাষিরা ক্ষোভের সঙ্গে জানান প্রতিবছর এই হাওরে কোটি কোটি টাকার বোরো ধানের উৎপাদন হয়। আগাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসলের ক্ষতি হয়। সর্বস্বান্ত হয় কৃষক। তারপরও এ হাওরের বোরো ধান রক্ষায় সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেই। এমন অবহেলা হাওর অঞ্চলের মানুষকে পীড়া দেয়। আমরা আশা করব এ বছর হাওরপাড়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা জেনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সদয় হবেন।
পাউবো মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, হাকালুকি হাওরে পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দূর করতে সেচ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ.ক.ম শফিক উজ জামান বলেন, হাকালুকিতে মাছ ও বোরো চাষ হয়। তাই কৃষি ও মৎস্যজীবীদের কল্যাণে স্থায়ী উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন। জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহজাহান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে হাওরের ফসল রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের নয়। আমরা শুধু কৃষকদের ভালো ফসল উৎপাদনের পরামর্শ দেই। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, হাকালুকি হাওর হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরসহ জেলার অনান্য হাওরকে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত না করায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ক্ষোভের অন্ত নেই। তাদের দাবী দ্রুত জেলার হাওরগুলোকে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ।

Post a Comment

Previous Post Next Post