'ওথেলো সিন্ড্রোম' - ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম

'ওথেলো সিন্ড্রোম' - ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম
ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম: সেক্সপেরিয়ান ট্রেজেডিগুলোর মধ্যে ওথেলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমি ছেলেবেলায় সম্ভবত ক্লাস টেনে পড়ার সময় এই নাটক টির অনুবাদ সংগ্রহ করে পড়ি। এই নাটকের শেষ অংশে নায়ক ওথেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী ডেসডোমিনাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। ডেসডেমিনার প্রতি তার অবৈধ প্রণয়ের সন্দেহ এই হত্যার মূল কারণ। পরে অবশ্য তার ভুল ভাঙ্গে। সে জানতে পারে তার প্রিয়তমা স্ত্রী নিষ্পাপ। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। পরে সেও আত্মহত্যা করে। নিছক সন্দেহের বশীভূত হয়ে স্ত্রী হত্যার এমন কাহিনী থেকে ‘ওথেলো সিন্ড্রোম’ রোগের নামকরণ হয়।
‘ডিলিউসন অব জেলাস’ রোগ ই আসলে ‘ওথেলো সিন্ড্রোম’ নামে পরিচিত। স্ত্রী বা স্বামীর প্রতি তীব্র সন্দেহ পোষণ করাই এই রোগের প্রধান  লক্ষণ। সাধারণত পুরুষরা এই রোগে বেশি ভোগেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে মহিলার মধ্যেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ দেখা যায়।
ওথেলো সিনড্রোমের রোগীরা বা রোগীর স্বজন রা লজ্জার ভয়ে অথবা অজ্ঞতার জন্য চিকিৎসকের/নিউরো-সাইকিয়াট্রিস্ট  এর শরণাপন্ন হতে চান না। এ রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগই রোগী নিজেকে সুস্থ মনে করেন। নিজের সন্দেহকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন। এই মিথ্যা অলীক বিশ্বাসের কারণে অনেক সময় এসব রোগী শেষ পর্যন্ত তাদের স্ত্রীকে বা স্বামীকে হত্যা  করে ফেলেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হত্যা করার জন্য জেলে গেছেন এমন মহিলা বা পুরুষের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশই ‘ওথেলো সিনড্রোম’-এর রোগী। বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা, সিজোফ্রেনিয়া, মুড ডিসঅর্ডার, এলকোহল বা মাদকে আসক্তি প্রভৃতি। এছাড়া কিছু শারীরিক অসুখের কারণেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ হতে পারে। যেমন ব্রেইন  টিউমার, এন্ডোক্রাইন ডিসঅর্ডার ও মেটাবলিক ডিসঅর্ডার প্রভৃতি।
 
ওথেলো সিন্ড্রোম রোগের উপসর্গ: স্ত্রীর সতীত্বের প্রতি তীব্র সন্দেহবোধ হলো রোগের প্রধান উপসর্গ। রোগী মনে করেন, তার স্ত্রী গোপনে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন। স্ত্রী যদি সামান্য সাজগোজ করেন, তাহলে রোগী মনে করেন গোপন প্রেমিকের জন্যই এই সাজগোজ। এ নিয়ে রোগী সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন। এক ধরনের ক্রোধ তার মধ্যে কাজ করে। সামান্য কথাতেই রিয়েক্ট করেন। স্ত্রীর কলিগদের ও সন্দেহের চোখে দেখেন। তার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। গোপনে স্ত্রীর প্রতি নজর রাখেন। স্পাই নিযুক্ত করেন। হঠাৎ অফিস বা বাসায় চলে আসেন স্ত্রীর অবস্থান দেখতে। স্ত্রীর কাপড়-চোপড় গোপনে পরীক্ষা করেন। গোপনে স্ত্রীর ডায়েরি, কাগজপত্র, ফেইসবুক, টুইটার ঘাটাঘাটি করেন। স্ত্রীর নামে কোনো চিঠি এলে তা সরিয়ে ফেলেন। পড়ে দেখতে চান তা কার লেখা। বাসায় ফোন থাকলে মাঝে মধ্যেই ফোন করে দেখেন স্ত্রী বাসাতেই আছে কি-না। ফোন এনগেজ্ড থাকলে তার সন্দেহ দৃঢ় হয়। রোগীর মধ্যে প্রচ- ঈর্ষার জন্ম নেয়। অনেক সময় তার নিজের যৌন অসততার প্রতিফলন তার স্ত্রীর মধ্যেই দেখেন। স্ত্রীর চারিত্রিক কল্পিত অসততার কথা আত্মীয়-স্বজনকে বলেন। পদে পদে স্ত্রীকে হেয় করতে চান। স্ত্রী অপমানিত হলে মনে মনে খুশি হন। স্ত্রীকে নানাভাবে নির্যাতন করেন। জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চান। তার বিশ্বাস জন্মায় যে, স্ত্রী তার অর্জিত টাকা-পয়সা অবৈধ প্রণয়ের পেছনে খরচ করে তাকে নিঃস্ব করতে চায়। এসব চিন্তা করে তার স্ত্রীকে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। দুশ্চিন্তায় রোগীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে। অনিদ্রা দেখা দেয়। মদে বা অন্য নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। এমন কি স্ত্রী সন্তান প্রসব করলে সেই সন্তানকে ও অবৈধ মনে করে তাকেও তিনি নির্যাতন করে থাকেন। অমুলক হলেও একসময় সন্দেহ প্রচ- বিশ্বাসে পরিণত হয় এবং এ থেকে স্ত্রী ও সন্তান কে হত্যা করে বসেন।
চিকিৎসা: ‘ওথেলো সিনড্রোম’ চিকিৎসা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ স্নায়ু ও মনোরোগ চিকিৎসকগণ অত্যন্ত যতœ ও সতর্কতার মাধ্যমে ওষুধ ও বিহেভ থেরাপি মাধ্যমে এ ধরনের রোগীকে সুস্থ করে ভয়াবহ পরিণাম থেকে পরিবারকে রক্ষা করতে পারেন। এ জন্য চিকিৎসক স্ত্রী ও স্বামী দু'জনের সঙ্গে পৃথক ভাবে কথা বলতে হয় এবং তাদের কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে। সাইকিয়াট্রিস্ট্রা রোগীর বিশ্বাসের ভিত্তি এবং স্ত্রীর বা স্বামীর প্রতিক্রিয়া জানেন। রোগীকে বিশেষ মাত্রায় অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধের পাশাপাশি ‘বিহেভিয়ার থেরাপি’ দেন। তবে আমাদের দেশে এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতার হার অনেক কম। অল্প শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতের পাশাপাশি অনেক উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চবিত্তের মধ্যেও এ রোগ দেখা যায়। শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে এক পর্যায়ে পরিবার ভেঙ্গে যায় বা করুন পরিণতি হয়। আমার অনেক পেসেন্ট আছেন  যারা দীর্ঘদিন ধরে এ রোগে ভোগছেন এবং তারা অনেকেই সেরে উঠেছেন।
অজ্ঞতা বা অবহেলা নয় বরং রোগ নিরুপন, সঠিক চিকিৎসা এবং ভালোবাসা ও যতœ দিয়ে অথেলো সিন্ড্রোম এর ন্যায় অন্যান্য কঠিন ব্রেইন ও মানসিক  রোগগুলোকে জয় করা সম্ভব।
- ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম: ব্রেইন স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

Post a Comment

Previous Post Next Post