ঝুঁকিপূর্ণ কুলাউড়ার মনু ও পলকী নদীর রেলসেতু

ঝুঁকিপূর্ণ কুলাউড়ার মনু ও পলকী নদীর রেলসেতু
ইমাদ উদ দীনঃ রেল বিভাগের দাবি ঝুঁকিহীন। তারপরও উদ্বিগ্ন যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ, সেতু দুটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের পর বেঁকে যাচ্ছে সব স্লিপার। আর পুরনো ক্লিপ-হুক, নাট-বল্টু, ফিশপ্লেট যে কটি আছে সেগুলো ট্রেনের ঝাঁকুনিতে নড়াচড়া করে স্থানচ্যুত হচ্ছে। সেতু দুটির মধ্যখানে ও তীরবর্তী দু’পাশের রেললাইনের বেশ কয়েকটি স্থানে নেই ক্লিপ-হুক, নাট-বল্টু আর ফিশপ্লেট। লাইনের জোড়া লাগানো অংশের নাটগুলোও অকেজো।

৪-৬টি নাটের মধ্যে ১-২টি নাট কাজ করলেও অন্যগুলো আছে নামমাত্র। আর সেতু দুটির ওপরে কাঠের জরাজীর্ণ স্লিপারের অধিকাংশই নষ্ট। এমনকি সেতুর মধ্যখানে ও উত্তর পাশের সীমানা অংশে নেই ৫-৬টি স্লিপার। আবার অনেক স্থানে স্লিপার সরে ফাঁকা হয়ে গেছে। ট্রেন চলাচলে যাতে স্লিপারগুলো বাঁকা না হয় সে জন্য পুরো সেতুর রেললাইনে সম্প্রতি লম্বা করে ফালি করা বাঁশে পেরেক দিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে স্লিপার আটকানোর চেষ্টা চালিয়েছে রেল বিভাগের কর্মীরা। তারপরও বেঁকে যাচ্ছে স্লিপার। তাই ট্রেন যাওয়া আসার পর কিম্যানের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা হাতুড়ি পিটিয়ে বেঁকে যাওয়া স্লিপার পুনরায় সোজা করছেন। 

সরজমিন সিলেট-আখাউড়া রেলপথের কুলাউড়ার ২০৫নং পলকী নদী ও ২০৬নং মনু নদী রেলসেতুতে এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে। সেতু দুটিতে দীর্ঘদিন থেকে কোনো মেরামত না করায় এখন দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এমনটিই জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে ব্রিজ দুটির ওপরের রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলাচলে কোনো ঝুঁকি নেই বলে অভিমত রেল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের। তবে রেল বিভাগের এমন অভিমত মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন মহল। তারা জানালেন, বৃটিশ আমলের নির্মিত ব্রিজ দুটির ওপরে রেললাইনের এমন বেহাল দশা এর আগে কখনো দেখেননি তারা। ট্রেন যাওয়া আসার সময় বিকট শব্দে সেতুর ওপরের রেললাইন কেঁপে স্লিপার বেঁকে যাচ্ছে। আর ক্লিপ-হুক, নাট-বল্টু, ফিশপ্লেটগুলো ট্রেনের ঝাঁকুনিতে নড়াচড়া করে স্থানচ্যুত হচ্ছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, প্রতিবছরই মেরামতের জন্য বরাদ্দ এলেও কোনো কাজ হয়নি এই দুটি সেতুর রেললাইন ও আশপাশের রেললাইনে। তারা অভিযোগ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও পকেট ভারির চিন্তায় দিন দিন ঝুঁকিতে পড়ছে এই সেতু দুটির রেললাইন ও সিলেট-আখাউড়া রেললাইন। 

ঝুঁকিপূর্ণ কুলাউড়ার মনু ও পলকী নদীর রেলসেতু
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই রেলসেতু দুটির ওপরের রেললাইনের বেহাল দশায় আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ, এই স্থানে কোনো ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে নাশকতা বলে রেল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়সারা বক্তব্য দিয়ে কিংবা তদন্ত করে আমাদের নাশকতাকারী বানিয়ে মামলার আসামি করবেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, টিলাগাঁও এলাকায় এরকম একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় তাদের এলাকার অনেকেই নাশকতার আসামি হয়ে এখন মামলার ঘানি টানছেন। তাই মেরামতের আগ পর্যন্ত এই ঝুঁকিপূর্ণ দুটি স্থান নিয়ে তারা রয়েছেন শঙ্কায়। সরজমিন ব্রিজ দুটির ওপরের রেললাইনের এমন বেহাল দশা চোখে পড়ে। ম্যাইট ম্যান দিল মোহাম্মদের তদারকিতে ট্রেন যাওয়ার পর কিম্যান কামাল হোসেন (৪০) ও রহমান আলী (৫৩) হাতুড়ি পিটিয়ে সেতুর ওপরের রেললাইনের বেঁকে যাওয়া স্লিপার মেরামত করছেন। তাদের এমন হাতুড়ি পেটায় পুরানো রেলের কাঠের স্লিপারগুলো ভেঙে পড়ছে। রেলওয়ের এই কিম্যানরা (রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী) সেতুর ওপরে নাট-বল্টু লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্লিপারের সঙ্গে নিচের গার্ডারের সংযোগ দেয়ার চেষ্টা করছেন। এখন দিনে দুই-তিনবার ওখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তারা। কোথাও ত্রুটি থাকলে সারেন। আগে এমন মেরামতের কাজ না করলেও এখন ঝুঁকি এড়াতে প্রতিনিয়তই তারা এমন কাজ করছেন বলে আলাপে জানা গেল। 

বাঁশের ফালি লোহার পেরেগ দিয়ে স্লিপারের সঙ্গে আটকানো কেন জানতে চাইলে ম্যাইট ম্যান দিল মোহাম্মদ জানান, কাঠের স্লিপার যাতে স্থানচ্যুত না হয় সে জন্য এ ব্যবস্থা। নাট বল্টু নড়ছে, স্লিপার স্থানচ্যুত হচ্ছে, এ অবস্থায় ট্রেন চলাচলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি দৃঢ়ভাবে জানালেন- না। তবে সেতু দুটির ওপরের রেললাইনের অবস্থা যে নাজুক প্রথমে তিনি তা অস্বীকার করলেও নানা ত্রুটি বাস্তবে দেখিয়ে দিলে পরে তিনি তা স্বীকার করেন। তিনি জানান, ৩১৫/৫ থেকে ৩০২/৮ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তা ২ জন কিম্যান ৪ জন ওয়াইম্যান ও ১ জন ম্যাটম্যান দেখভাল করছেন। 

তবে ওই দুটি সেতু এলাকা ছাড়াও সরজমিন আশপাশের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের ভেতরে নেই পর্যাপ্ত পাথর। রেলপথে স্লিপারে নাট-বল্টু দিয়ে রেললাইন আটকানোর কথা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে নেই ক্লিপ, নাট ও বল্টু। দুই লাইনের জোড়া দেয়া স্থানেও নেই ক্লিপ ও ফ্লিশপ্লেট। তবে রেল বিভাগের অভিযোগ, প্রতিনিয়ত রেলপথ থেকে এসব যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় এসব যন্ত্রাংশ না থাকায় সেকশনটি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। চুরি হয়ে যাওয়া কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া এসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না। ফলে এই সেকশন দিয়ে ঘণ্টায় ৬০ কিমি. বেগে প্রতিদিনই যাত্রীবাহী আন্তঃনগর, লোকাল ও মালবাহী ট্রেন মিলে প্রায় ২৫টি ট্রেন ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, মনু নদীর ওপর প্রায় ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুতে ২০৮টি স্লিপার রয়েছে। সেতুটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন বা কেপিআই) মধ্যে পড়েছে। মনু রেলস্টেশনের পাশ ঘেঁষেই সেতু দুটির অবস্থান। মনু ব্রিজের পরেই অবস্থান পলকী নদী ব্রিজের ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটিতে ১৬৯টি স্লিপার রয়েছে।

তবে দীর্ঘদিন থেকে মনু স্টেশনে মাস্টারসহ লোকবল না থাকায় ঝুঁকির মুখে থাকা সেতু দুটিতে যেকোনো সময়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্রেনচালক জানান, ট্রেন চালানোর সময় রেললাইনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কোনো কারণে স্লিপার স্থানচ্যুত হয়ে রেললাইন সরে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হবিগঞ্জের লস্করপুর থেকে কুলাউড়ার টিলাগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত এলাকার দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী আলী আজম বলেন, কাঠের সংকটের কারণে নতুন স্লিপার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুরনো কাঠের স্লিপার জায়গা মতো না থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থেই পেরেক দিয়ে বাঁশের টানা দেয়া হয়েছে। তবে পুরো রেলপথে ১৫ থেকে ৩০ দিন অন্তর প্রকৌশলীরা পর্যবেক্ষণ করছেন। আমাদের তরফে রেলপথ ঠিক রাখতে যথাসম্ভব চেষ্টার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না এবং ট্রেন চলাচলে কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নেই বলে তিনি দাবি করেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post