খঞ্জরের আঘাতে প্রকম্পিত কুলাউড়ার ইমামবাড়া

খঞ্জরের আঘাতে প্রকম্পিত কুলাউড়ার ইমামবাড়া
স্টাফ রিপোর্টারঃ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নে নবাববাড়ির ইমামবাড়া প্রাঙ্গন ছিলো লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে একই তালে জিঞ্জির, ছুরি ও খঞ্জরের আঘাতে আঘাতে মাতম ছিলো হায় ‘হোসেন হায় হোসেন’।

আহাজারি আর ক্রন্দনে ইমামবাড়ার আকাশ-বাতাস হয় প্রকম্পিত। ছুরি-খঞ্জরের আঘাতে নিজ শরীরকে রক্তাক্ত করেছে শিয়া অনুসারীরা। বুধবার নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় উপজেলার পৃথিমপাশায় তাজিয়া মিছিলের মাধ্যমে শেষ হলো ১০ দিনব্যাপী চলা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি। 
খঞ্জরের আঘাতে প্রকম্পিত কুলাউড়ার ইমামবাড়া

সিলেট বিভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া সম্প্রদায়ের পরিবারের বসবাস পৃথিমপাশায়। যার ফলে প্রায় ৩০০ বছরের অধিক সময় ধরে এখানে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে আসছে পৃথিমপাশার শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীরা। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত কয়েক হাজার শিয়া মুসল্লিদের অংশগ্রহনে হয়েছে তাজিয়া মিছিল।

পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী নবাববাড়ি, তরফি সাহেব বাড়ি, মনরাজ বাড়ি, ছোট সাহেব বাড়ি, বাঘ বাড়ি, মরহুম শাহাদাত হোসেনের বাড়ি, গোলাম হোসেনের বাড়ি, পাল্লাকান্দি সাহেব বাড়িতে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে শোক অনুষ্ঠানসূচি যেমন মার্সিয়া, মাতম, আহাজারি, ক্রন্দন, নোওয়া, জারি, মিলাদ, তবরুক, জলসা পালিত হয়েছে।

নবাব পরিবারের বংশধর সাবেক সংসদ সদস্য নবাব আলী আব্বাস খানের নেতৃত্বে মহররমের শোক অনুষ্ঠান মজলিস, মাতম, নোওয়া, জারি এবং বিকালে তাজিয়া শোক মিছিল অনষ্ঠিত হয়েছে। মিছিলটি পৃথিমপাশা ইউনিয়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে নবাব বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়। 
খঞ্জরের আঘাতে প্রকম্পিত কুলাউড়ার ইমামবাড়া

শিয়া মুসলিম ভক্ত অনুসারীরা এসময় ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনীর মধ্যে দিয়ে নিজ শরীরে জিঞ্জির ও ছুরি দিয়ে আঘাত করে হযরত ইমাম হোসেনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে। শোক পালনের এমন দৃশ্য দেখতে দেশ বিদেশ থেকে আগত কৌতূহলী লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে নবাববাড়ির ইমামবাড়া প্রাঙ্গণ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৬১ হিজরীতে মহররম মাসের ১০ তারিখ ফোরাত নদীর তীরে পবিত্র কারবালা প্রান্তরে বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও উনার সঙ্গীরা ইসলামের জন্য শাহাদাত বরণ করেন।

কারবালায় ঘটে যাওয়া ঘটনাকে লালন করে মুসলিমরা প্রতি বছর মহররম মাসে ইবাদত (দোয়া, দরুদ, শিরনী, সালাত, নফল রোজা, তাসবীহ পালন) বন্দেগী করে। আর শিয়া সম্প্রদায়ের মুসল্লিরা হৃদয়বিদারক বেদনাবিধুর সেই শোকস্মৃতি স্মরণে তাদের রীতি অনুসারে মহিমান্বিত দিনটি তাৎপর্য, গুরুত্ব ও শিক্ষায় উদ্ভাসিত হয়ে শ্রদ্ধায়, সম্মানে, আবেগে, ক্রন্দনে আর মার্সিয়ায় পালন করেন। যুগ যুগ ধরে এখানে পালিত হচ্ছে এই ধর্মীয় রীতি।

লক্ষ্য, উপলক্ষ, স্মরণ, শ্রদ্ধা, শিক্ষা, শোকস্মৃতি যা-ই বলেন না কেন, ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা একটা অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছর মহররম মাস এলে নবাববাড়ির ইমামবাড়ার প্রাঙ্গণসহ পুরো পৃথিমপাশা ইউনিয়ন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এই ১০ দিনের জন্য নবাববাড়ির সামনে দোকান-পাঠের মেলা বসে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেকেই এখানে আসেন চাকু ও ছুরি দিয়ে শিয়া ভক্তদের শরীরের রক্ত ঝরিয়ে ত্যাগের মহীমায় হায় হোসেন হায় হোসেন মাতমের মাধ্যমে কারবালার সেই শোকস্মৃতি দেখতে।

পৃথিমপাশা ইমাম বাড়ার মোতাওয়াল্লি ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাছ খান জানান, ‘তাদের এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সকল ধর্মের লোকজন একত্রিত হন যাতে করে এক অসাম্প্রদায়িক মুহূর্তের অবতারনা হয়। কোন রকম অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছাড়া তাজিয়া মিছিল ও ছুরি মাতমসহ পবিত্র আশুরার সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জনসাধারণসহ সকলকে ধন্যবাদ জানান।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুদ্দোহা পিপিএম জানান, নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও যে কোন অপ্রিতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শতাধিক সদস্য মাঠে ছিলেন।

তাজিয়া মিছিলের মধ্য দিয়ে এখানকার শিয়া সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠান শেষ হলেও রীতি অনুযায়ী ৪০ দিন পর্যন্ত চলবে এই শোকস্মৃতি স্মরণে বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগি।

Post a Comment

Previous Post Next Post