বিশেষ প্রতিনিধিঃ শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃক আটক যাত্রী ইমাম হোসেন (৩০) এর পাকস্থলিতে লুকানো ইয়াবা অবশেষে তার পায়ুপথে দফায় দফায় ১০০টি পোটলায় বের করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে শাহজালালে আটক হওয়ার পর তাকে সন্ধ্যায় RAB এর সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তা প্রহরায় ভর্তি করা হয়। মানব শরীরে এজাতীয় ইয়াবা লুকানোর কৌশল ও উদ্ধার করার নাটকীয়তা এবং গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
গত মঙ্গলবার আটক ইমাম হোসেনকে গ্রেফতার দেখিয়ে বিমানবন্দর থানায় সোপর্দ করা হয়। মামলা নং ২১, তারিখঃ ১৬/০৮/২০১৬। শুল্ক আইন, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে।
আটক যাত্রী তাসনিম ফকরুল হিসেবে ছদ্মনামে কক্সবাজার থেকে নোভো এয়ারের একটি ফ্লাইট VQ932 এর মাধ্যমে রবিবার ১২:৪৫ টায় ঢাকায় অবতরণ করেন। ঢাকায় আসার পর তাসনিম ফকরুল নাম ধরে ডাকাডাকির পরেও না পেয়ে হতাশ হওয়ার উপক্রম গোয়েন্দাদের। আসল নাম ধরে ডাকার পর ইয়াবাবাহক সাড়া দিলে ধরা পড়ে যায় ইমাম হোসেন। সাথে সাথে হাতকডা। মানুষ স্বভাবজাতভাবে ভালো হওয়ায় ছদ্মনাম ভুলে নিজের নামে সাড়া দেন এই নির্বোধ মানুষটি।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হলে প্রথমে তিনি ইয়াবা থাকার কথা অস্বীকার করেন। তার হ্যান্ড ব্যাগে ব্যাপক তল্লাশি করার পরও এই ইয়াবা না পাওয়ায় তার পেটে চাপ দিয়ে ইয়াবার অস্তিত্বের সন্দেহ হওয়ায় তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি সরলভাবে স্বীকার করেন। তিনি জানান যে, ৪০টি করে মোট ১০০টি ছোট পোটলায় ৪০০০ পিস ইয়াবা আছে। নিজে একজাতীয় সিরাপ খেয়ে বের করার উদ্যোগ নেন ইমাম হোসেন। এতে ঝুঁকি আছে বিবেচনায় RAB এর সহায়তায় ঢাকা মেডিকেলের হাসপাতালে রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় ভর্তি করা হয়। ডাক্তার তাৎক্ষণিকভাবে এক্সরে করে ইমাম হোসেনের পেটে ইয়াবার পোটলার অস্থিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
একসঙ্গে ১০০টি পোটলা হওয়ায় এবং দীর্ঘক্ষণ পেটে থাকায় এগুলো বের করতে ঝুঁকি আশঙ্কা করেন ডাক্তার। অপারেশন করার কথাও বিবেচনা করা হয়। পরে ডাক্তারের রক্ষণমূলক চিকিৎসার অংশ হিসেবে 'একুয়ালাক্স' নামক ঔষধ খাইয়ে এগুলো বের করার সিদ্ধান্ত নেন।
কাজে দেয় এই চিকিতসা। তবে উৎকন্ঠা ছিল ডাক্তারের। কোন কারণে পোটলা ফেটে গেলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না। 'তাহলে মামলার কী হবে? এর সাথে কারা জড়িত তা বের হবে কীভাবে?', একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্বেগ। বললাম জান আগে, পরে মামলা।
এই ঔষধ খাওয়ার এক ঘন্টা পর হতে দফায় দফায় এই পোটলাগুলো বের হতে শুরু হয়। মোট ১০ ঘন্টা সময় নিলো। রাত পার। সাথে গোয়েন্দাদের নির্ঘুম রাত কাটা। সর্বশেষে পোটলা বের হয় সোমবার ভোর ৫টায়। পোটলাগুলো পায়ুপথের ময়লাযুক্ত অবস্থায় একটি গামলায় রাখা হয়। ইমাম হোসেন নিজেই এগুলো পরিস্কার করেন। ইমাজেন্সিতে ওয়ার্ড ২১৯ এর বেড ৭ এ সিনিয়র ডাক্তার প্রফেসর এবিএম খুরশিদ আলমের চিকিৎসাধীন ছিলেন। বার বার টয়লেটের চাপে এবং অতিরিক্ত ফ্লুইড যাওয়ায় যাত্রী অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং পরে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে তাকে সোমবার বেলা ১২ টায় অবমুক্ত করা হয়।
এরপর শুল্ক গোয়েন্দা তাকে শাহজালালে ফেরত এনে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করে। দুর্গন্ধযুক্ত এসব পোটলাগুলো একে একে খুলে ৪০০০ পিস লাল রঙের ইয়াবা পাওয়া যায়। প্রতি পোটলা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন এগুলো পেটে হজম না হয়। প্রথমে পাতলা পরিস্কার প্লাস্টিক দিয়ে আবরণ দিয়ে ঢাকা হয়। দ্বিতীয় স্তরে মোটা লাল রঙের স্কচ টেপ দিয়ে মোড়ান। তৃতীয় স্তরে আবার হালকা ও নরম প্লাস্টিক দিয়ে আটকানো হয়। দেখতে বড় সাইজের পটলের মতো।
তবে পোটলাগুলো মসৃন মনে হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান যে, রবিবার ভোর পাঁচটায় তিনি এগুলো ৬টি সাগর কলার সাথে গিলে খান। খাওয়ার পর তার খাদ্যনালীতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। বমি ঠেকানোর জন্য এবোমিন জাতীয় টেবলেটও খেয়েছেন। গলায় ব্যাথা নিয়েই টেকনাফ থেকে সড়কপথে তিনি কক্সবাজার আসেন এবং দুপুরে প্লেনে উঠেন। তার এক সহযাত্রী নুরুল আমিন (৩০) কক্সবাজার আটক হন। ইমাম হোসেনের ব্যাগ তল্লাশি করা হলেও পেটের ভেতর লুকানো ইয়াবা ধরা না পড়ায় ঢাকা আসতে পেরেছেন।
তিনি আরও জানান, ১৫,০০০ টাকার বিনিময়ে এই ইয়াবার পোটলা গিলেছেন। তিনি পেশায় মাছ ধরা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। বাড়তি আয়ের জন্য এই প্রথম তিনি এই কাজে লিপ্ত হন। তার ৬ বছরের ছেলে ও ৩ বছরের একটি মেয়ে আছে।
ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে ইমাম হোসেন আরো জানান, মাছ ধরতে গিয়ে মায়ানমার থেকে আসা ট্রলার হতে এসব ইয়াবা বাংলাদেশি ট্রলারে স্থানান্তর হয়। এসব ট্রলারে ইয়াবা এসে টেকনাফে কোথাও জমা হয়। পরে তা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নেয়া হয়। এর সাথে বড় লোকজন জড়িত। তবে তিনি তাদের চিনেন না।
পেটের ভেতর ইয়াবা লুকিয়ে যাতায়াত এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়ানো সহজ বলে তিনি জানান। তবে তিনি এই প্রথম পেটে করে ইয়াবা এনেছেন, জানান তিনি। ঢাকায় তিনি প্রথম এসেছেন। তবে কেউ একজন তাকে রিসিভ করার কথা। টেকনাফের আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তি এই ইয়াবার ব্যবসা মধ্যস্থতা করেছেন এবং তিনি (আবুল কাশেম) এই চালানের মালিককে চিনেন।
চোরাচালানের আইন কঠিন। দায়ের করা মামলাতে ইমাম হোসেনের সর্বোচ্চ যাবৎজীবন পর্যন্ত জেল হতে পারে। মামলার সূত্রে এখন তদন্তকারী সংস্থা/কর্মকর্তা আরো গভীরে গিয়ে ইয়াবা ব্যবসার হোতা ও ডালপালাকেও আইনের আওতায় আনতে পারলে আরো সফলতা আসবে। ইয়াবা পাচারকারীদের জন্য দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির নজির হতে পারে।
সার্বিকভাবে, পেটের ভেতর লুকানো ১০০টি পোটলায় ময়লাযুক্ত ৪০০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার এই প্রথম অভিনব গোয়েন্দা ঘটনা। যে প্রক্রিয়ায় এটি উদ্ধার হলো তাতে উতকন্ঠা থাকলেও নাটকীয়তার অবসান হয় সফলভাবে। কোন অঘটন ঘটেনি। অন্যদিকে, এই ইয়াবা ইমাম হোসেনের মতো সহজ মানুষের শরীরে লুকানো প্রক্রিয়ায় অমানবিকতা ও জীবনের চরম ঝুঁকি থাকায় ইয়াবা সেবীদের বোধোদয় হওয়াটা বাঞ্চনীয়। এসব মাদক এমনিই ক্ষতিকর; অধিকন্তু, অস্বাভাবিকভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ও নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাচার হওয়ায় এসব মাদক সেবনের জন্য সর্বদা নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং মানবিক নয় সেই ইঙ্গিতই বহন করে।