তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকীকরণে আত্নার বন্ধন ছাড়িয়ে বৈশ্বিক কৃত্রিম মায়ায় আবদ্ধ আজকের মানবসমাজ। আমরা "Global Village" এর উপকারিতা যেমন ভোগ করছি ঠিক তেমনিভাবে ভোগ করছি তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিচরণে বিষাদ বেমানান ভিত্তিহীন ভয়াবহ তিক্ত অভিজ্ঞতা।
আজকের দিনে "ট্রল" শব্দের সর্বোপরি ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা সবার মুখে মুখে।অতিক্ষুদ্র থেকে অতিবৃহৎ বিষয়গুলো 'ট্রল' নামের আড়ালে অবমাননা করে চলেছে ব্যক্তি এবং সমাজকে।স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের অন্তরালে চলে যাচ্ছে এই 'ট্রল' নামের ভয়াবহতায়।
অনেকের মতামত হতে পারে 'ট্রল' আমরা নিছক আনন্দের জন্য করছি কিংবা 'ট্রল'কে আমাদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করছি।বিনোদনের একটি মাধ্যম হিসেবে 'ট্রল' কে মেনে নিলাম কিন্তু আপনার বিনোদনের অট্টহাসি যদি কারো বিক্ষুব্ধ বিষাদ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কষ্টের বাঁধভাঙা অশ্রুকণার কারন হয় তাহলে সেই বিনোদনের যৌক্তিকতা আছে কি?
অনেক সময় আপনি কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে নয় নিছক বিনোদনের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অনান্য জায়গায় এমনকিছু শেয়ার করছেন কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতার খোঁজ নিচ্ছেন কি?
সদ্য জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ফলে আমরা এর সত্যতা যাচাই না করেই ট্রলের মিছিলে অতিউৎসাহে যোগ দিলাম কিন্তু এই প্রতিবেদনে এস.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হল তাদের কথা একটিবার মনে করলাম না।পৃথিবীতে সত্যতা নির্ণেয়র মাপকাঠি আজ অনেক বিপরীতে অসত্যতার দৌড়ঝাঁপ আরো বেশি।পরবর্তীতে আমরা দেখলাম উক্ত প্রতিবেদনের সত্যতা;জি.পি.এ-৫ এর পরিবর্তে ২০১৬ সনের এস.এস.সি পরীক্ষায় তানভীর আহমেদ পেয়েছিল জি.পি.এ-৩.৬১ ।আমাদের 'ট্রল' আর অমানবিক সাংবাদিকতার উপহার স্বরূপ তানভীর নিজ ঘরের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বুনেছিল পৃথিবী ত্যাগের কালোচিত নকশা,ভাগ্যিস এই কালোচিত নকশা বাস্তব হয়নি।অবমাননা আর ট্রলের নির্মম উপহার বাস্তব হলে এর দায় কি কেউ এড়াতে পারতাম?
ব্যতিক্রম আর উদাহরণ কি এক?এই কয়েকজনের সাক্ষাতকারে আমরা শিক্ষাব্যবস্থা নড়বড়ে বলে দাবি তুললাম।এখন প্রশ্ন হল, তানভীররা যদি ব্যতিক্রম হয়েও উদাহরণ হয়ে যায় তাহলে তা শিক্ষাব্যবস্থার কারনে কিন্তু সে দায় ওরা বহন করবে কেন?কেন তাদেরকে নিয়ে 'ট্রল' করা হবে?তাহলে আমরা সবাই কি ভিন্ন গ্রহের মানব?আমরা কি এই শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের কেউ?না আমি আপনি অতি মেধাবী?
এখানে মৌলিক কিছু বিষয়ের তারতম্য হয়েছে ঠিক কিন্তু এর যথাযথ সত্যতা প্রমাণিত নয়।কারো একমাত্রিক মেধা দিয়ে যাচাই করার মাপকাঠি আপনি কোথায় পেলেন?পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেক উদাহরণ বিদ্যমান যাঁরা মুখস্থ বিদ্যার মাধ্যমে নয় বরং সৃজনশীলতায় জয় করেছেন বিশ্বকে,এর মানে এই নয় যে মুখস্থকরণ অনাবশ্যক।মেধা বহুবিধ,মেধা বহুবিদ বলেই পৃথিবীজোড়া ভিন্নত্ব পরিলক্ষিত হয় আর সবার কাছে সবার প্রয়োজনীয়তা অক্ষুণ্ণ থাকে।
আরেকটি ট্রলের উদাহরণ -
একজন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপলোড করে বাংলায় ক্যাপশন লিখেছিলেন কিন্তু সেই লেখায় অনেকগুলো বানান ভুল ছিল।সেই স্ট্যাটাসে কোথায় কোথায় বানানের ভুলছিল তা চিহ্নিত করে উনার ছবি এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ছবি যুক্তকরে ট্রল করা হলো
''আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা দেখ মফিজ,বাংলা লিখতে পারেনা আবার ছবি আপলোড মারে, নাহিদের আমলে জি.পি.এ-ফাইপ পাইছেতো তাই" শিরোনামে।
এটি যেন বিনোদনের ছলে অবমাননার ঘৃণ্য উদাহরণ।উক্ত ট্রলের বানান ভুল চিহ্নিত করা একটি গঠনমূলক সমালোচনা কিন্তু ব্যক্তিকে আর শিক্ষাব্যবস্থাকে যেন হেও প্রতিপন্ন করা।বর্তমানে ট্রল পেইজগুলো নিজেরাই এমন অবাস্তবতার তৈরি করছে অন্যদিকে উক্ত ব্যক্তির বাংলা টাইপিং দক্ষতা হয়ত অতি অল্প আর শিক্ষাব্যবস্থা স্ট্যাটাস টাইপিং শেখায় না।বাংলাদেশের এই শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পি.এইচ.ডি ডিগ্রিধারী আছেন কিন্তু প্রযুক্তি জ্ঞান অল্প।তাই তাদের কে নিয়ে ট্রল করতে হবে?তাদের গ্রহণযোগ্যতা কি নাই?
এখানে মাননীয় মন্ত্রী অবমানিত,শিক্ষাব্যবস্থা অবমানিত,ছবি আপলোডকারী ব্যক্তি অবমানিত তথা সমাজ অবমানিত। আপনার গঠনগত সমালোচনার অধিকার আছে কিন্তু কাউকে অবমাননার অধিকার নেই।
ট্রল নিউজের বাস্তবতা আরো কঠিন। উল্লেখ্য বিনোদনের উদ্দেশ্যে আপনি ভিত্তিহীন এই ট্রলগুলো শেয়ার করা মানে নিজের অগোচরে এই নেতিবাচকতাকে সমর্থন করা।
"পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করো" এই প্রবাদের ঠিক উল্টো পথের পথিক হয়ে আর কত চলবেন?আজকে আপনি একজনকে অবমাননা করছেন আগামীকাল কি আপনি অবমানিত হবেন না?সঠিক বাস্তবতার প্রচার ও প্রসার করুন আর অসংগতির গঠনমূলক সমালোচনা করুন;ব্যক্তি অবমাননার নামে ট্রলকে প্রত্যাখ্যান করুন।
লেখক- মো. এনামুল হাসান কাওছার।
শিক্ষার্থী-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা।
ইমেইল- anamulhasan1971@gmail.com