আজ ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া মুক্ত দিবস

আজ ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া মুক্ত দিবস
নিউজ ডেস্কঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া উপজেলার রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যখন সমগ্র দেশে বিজয় উৎসব ধ্বনিত  হয় তার পূর্বে ০৬ ডিসেম্বর এই উপজেলা সর্ম্পূনরুপে শত্র“মুক্ত হয়। এরপর থেকে দিন টিকে কুলাউড়াবাসী শত্র“মুক্ত দিবস হিসাবে পালন করে আসছেন। বিজয়ের ৪৪বছর অতিবাহিত হলেও উপজেলার বধ্যভূমি গুলো সংরক্ষনের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বধ্য ভূমিগুলো। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্তে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কুলাউড়া ডাক বাংলো মাঠে নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৭১ সালের ৭মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকে ঠিক ঐ সময় পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ থেকে মুক্তি সংগ্রামে কুলাউড়ার দেশ প্রেমিক মুক্তিকামী সন্তানরা হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। এই উপজেলায় ব্যারিষ্টার আব্দুল মুক্তাকিম চৌধুরী, নবাব আলী সবদর খান রাজা, নবাব আলী সরওয়ার খান চুন্ন, আব্দুল লতিফ খান, মোঃ আব্দুল জব্বার, লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল, মোঃ আব্দুল মতিন, সুশীল সেনগুপ্ত, মোঃ মমরুজ বখ্শ মটু, আছকির আলী, আতাউর রহমান, মছাদুর রহমান, গিয়াস উদ্দিন আহমদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের সু-সংগঠিত করে ভারতে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই উপজেলায় সর্বমোট ৫৮২জন মুক্তিযোদ্ধা সংক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কুলাউড়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সহ প্রায় ৪৫০জন শহীদ হন। পাক বাহীনির প্রবেশ ও নির্মম গণহত্যা: কুলাউড়া শহরে পাক বাহীনির প্রবেশ পথে ৭১সালের ৭মে কাপুয়া ব্রীজের কাছে গতিরোধ করেন অকুতোভয় বীর সৈনিক মোজাহিদ আলী সহ জয়চন্ডী ইউনিয়নের আছকির আলী ও হাবীব উদ্দিন। শুরু হয় সংঘর্ষ এক পর্যায়ে আছকির ও হাবীব গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এই দুই জন’ই কুলাউড়া উপজেলার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তারপর পাক সেনারা একে একে হত্যা করে কটু মিয়া, আব্দুল কদ্দুছ, ছলিম উল্লাহসহ স্থানীয় ৫জন গ্রামবাসীকে। শহরের চৌমুহনায় এসে হত্যা করে ডেক্সী পাগল নামে একজনকে। এরপর বিকালে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্টানে হত্যা ও লুটপাট চালায়। শহরে প্রবেশ করে হত্যা করে ছাত্রলীগ থানা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম ভূইয়া ও তার সহকর্মী সহ-বোডিং ম্যানেজার আব্দুর রহমানকে।পরে কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকার সহযোগে পাক সেনারা ২২জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে। পরবর্তীতে ২৪ মে ও ১৪জুন মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা সহ একই গ্রামে গিয়ে নিধন যজ্ঞ চালায়। পাক বাহীনির ক্যাম্প তৈরী: পাক সেনারা থানা হাসপাতাল, রেলওয়ে ষ্টেশন, কুলাউড়া বালিকাউচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করে ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তানী মেজর মোগল ও ক্যাপ্টেন দাউদ। পাকিস্তানী সৈন্যের আগমনে স্বার্থানেষী ও স্বাধীনতা বিরোধীরা শান্তি কমিটি, আলবদল, রাজাকার, আল-সামস, কমিটি গঠন করে বাঙ্গালী নিধন যজ্ঞ চালায়। যে স্থানে রয়েছে বধ্যভূমি : স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা সমগ্র উপজেলাব্যাপী নির্মম হত্যা, গণহত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করে শহরের চাতলগাঁও কবরস্থান, কুলাউড়া নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী রেললাইন এলাকা, রেলওয়ে ষ্টেশনের দক্ষিণ এলাকা, বিছরাকান্দি ও উত্তর জয়পাশা এলাকা ছাড়াও পৃথিমপাশা আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখ্যস্থান পদ্ম দীঘির পার, সীমান্তবর্তী এলাকা শরীফপুর ইউনিয়নের নৌ- মৌজা নামক স্থানে গণকবর দেয়। এসব স্থানগুলো  আজও সংরক্ষন করা হয়নি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে
রয়েছে এসব বধ্যভূমি।
যে ভাবে শত্রুমুক্ত হয় কুলাউড়া: নভেম্বর শেষ প্রান্ত থেকে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ চুক্তি হওয়াতে যৌথ মিত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে যুদ্ধের গতি তীব্রভাবে বেড়ে যায়। থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা-বাগানে উক্ত চা-বাগানে যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য বাগানে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গা বাড়ী নামক স্থানে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। নভেম্বরের শেষদিকে গাজীপুর মুক্ত করার পরিল্পনা গ্রহণ করা হয় এতে নেতৃত্ব দেন এমএ মুমিত আসুক, প্রথমে সাগরনাল চা-বাগানে অবস্থান নেন তারা। উক্ত স্থানে মিলিত হন ধর্মনগর থেকে আগত কর্ণেল হর দয়াল সিংহ তার নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা বাহিনী ৬৭রাজপুত রেজিমেন্টের বিরাট একটি দল বাগানে অবস্থান নেয়। ৩০ নভেম্বর কাকুরা চা-বাগান অবস্থানকারী ৭৫জন
রাজাকার ও ৫জন পাকিস্তানী সৈন্য ধরা পড়ে। ০১ডিসেম্বর কাকুরা চা-বাগান থেকে গাজীপুর চা-বাগান এলাকার দিকে মিত্র বাহিনীরা অগ্রসর হলে পাক সেনাদের সাথে পাল্টা গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। ০২ ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধ হয়। ০৩ ডিসেম্বর ৪/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট কর্ণেল হারকিলের নেতৃত্বে একটি দল সাহায্যে এগিয়ে আসে। পেছনে ৯৯মাইন্টেল ব্রিগেডের আর্টিলারী সহায়তায় রাতে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় তবুও গাজীপুর চা-বাগান এলাকা দখল মুক্ত সম্ভব না হওয়াতে ০৪ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। পিছন দিক থেকে আক্রমন করার পরিকল্পনা নেন হারকিলর। সে অনুযায়ী এম এ মোমিত আসুক ও মোহন লাল সোম  পিছনে আসার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাত ১২টায় সম্মিলিত বাহিনী সবদিকে পাকিস্তানী বাহিনীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ দিকে লষ্করপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উক্ত যুদ্ধে প্রায় ২৫০জন পাক সেনা প্রাণ হারায়। ০৫ ডিসেম্বর গাজীপুর চা-বাগান এলাকা শত্রু মুক্ত হয়। ঐ দিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌছে, ঐ রাতেই সব পাকিস্তানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাজারের দিকে সড়ক পথে কুলাউড়া ত্যাগ করে। এভাবেই ০৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্র“মুক্ত হয়। উপজেলা শহরের লাল সবুজ স্বাধীনতার পতাকা আকাশে উড়তে থাকে। কুলাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুশীল চন্দ্র দে শত্রুমুক্তির স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, সেই দিনের পৈশাচিকতা এখনও স্মৃতিতে ভয়াল রুপ নিয়ে ফিরে আসে প্রতি বছর। ০৭মে থেকে ০৬ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনা ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, যুবক ও কৃষকসহ প্রায় ৪৫০জনকে হত্যা করে। তিনি এ বিজয়ের মাসে অবিলম্বে যোদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং উপজেলার সকল বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষনের জন্য যথাযথ কতৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান। অরক্ষিত বধ্যভূমি সংরক্ষনের ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসম কামরুল ইসলাম জানান, উপজেলা প্রশাসন থেকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলায় যেগুলো বধ্যভূমি রয়েছে তার প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের পরিকল্পনা রয়েছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post