মাহফুজ শাকিল: আমাদের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেন আমাদের ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন। গত ৮ অক্টোবর ছিল এ মহান মানুষটির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ শনিবার ঘড়ির কাঁটায় যখন সময় বিকেল ৪টা, তখন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় পৌঁছাই একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। প্রথমেই পরিচয়-পর্ব। এরপর হয় পরম আত্মীয়তা। ভাষা মতিনের সহধর্মিনী গুলবদেননেছা মনিকার আন্তরিক আত্মীয়তা দেখে আমি মুগ্ধ। তিনি আমাকে অ্যাপায়িত করলেন। তারপর দীর্ঘ দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। আমার সঙ্গে ছিল ঢাকা মোহাম্মদপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বন্ধুবর আব্দুল আহাদ রাশেদ। কথা হয় আমাদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে। আমি নিজেকে প্রথমে একজন সংবাদকর্মী ও ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিই। সংবাদকর্মী ও ছাত্র পরিচয় দেওয়ার পর তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন। ভাষা আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তী আব্দুল মতিন নিজেই একটি ইতিহাস। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গর্বের, অহংকারের। মানবতার জন্য ভাষানী ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের স্নেহধন্য মো. আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী ভাসানীর মাধ্যমে এই প্রযিততশা গুণী ব্যক্তির সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি বললেন, আমি সংবাদকর্মীদের অনেক স্নেহ করি, তাদের আমি সম্মান করি, তারাই দেশের বিবেককে জাগিয়ে তুলে। দেশের কল্যাণে তারা কাজ করবে। এরপর ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের কাছে বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলা ভাষার মতো এত সুন্দর ভাষা পৃথিবীর কোথাও নেই। বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে। এই বাংলার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, এই বাংলাকে ভালোবাসি। বাঙালি না হলে যুদ্ধ হতো না। আমরা বাঙালি হয়েছি বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভাষামতিন ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, ছাত্রদের জন্যই ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছে। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ছাত্রসমাজ সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আজকের ছাত্ররা বাংলা ভাষার যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। ফলে বাংলা ভাষা আজ সঙ্কটের মুখে। এ সঙ্কট থেকে বাংলা ভাষাকে উদ্ধার করতে হলে ছাত্রসমাজকে ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, সারাবিশ্ব যখন বাংলা ভাষার স্বীকৃতি দিচ্ছে, তখন আমরা বাংলাকে ভুলে অন্য ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করছি। বিশ্বে এমন কোনো জাতি নেই, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সংগ্রাম করেছে। ১৯৫২ সালে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে পৃথিবীতে যেসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙালির ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্ঠতম। যে কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মর্যাদায় দিবস হিসেবে পালিত হয়। তৎকালীন সময়ে তিনি ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। বাঙালির হাজার বছরের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ও সংগ্রামী পুরুষ আবদুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ধুবলিয়া গ্রামে। তিনি ভাই-বোনদের মধ্য সবার বড়। ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর বুধবার ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত বয়সের কাছে হার মানলেন ভাষা সংগ্রামের অকুতোভয় যোদ্ধা আব্দুল মতিন। মৃত্যু ছাড়া এর আগে আর কারোর কাছেই হার মানেননি তিনি। তার জীবন যেন এক নিরন্তর ছুটে চলা এক যোদ্ধার জীবন। ভাষা আন্দোলনে তার অসামান্য অবদানের জন্য জাতির কাছে তিনি ‘ভাষা মতিন’ হিসাবে পরিচিত। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৮ বছর। মৃত্যুকালে তিনি তিনি স্ত্রী গুলবদন নেসা, দুই মেয়ে মতিয়া বানু শুকু ও মালিহা শুভসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার সহধর্মিনী গুলবদেননেছা মনিকা জানান, আবদুল মতিন তার চোখের কর্নিয়া সন্ধানীকে ও দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন। তিনি আসলে মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি অমর হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমার মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ভাষা মতিনের সাথে জড়িত স্মৃতি আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভূলতে পারবনা। সেই সৌভাগ্যময় তার সান্নিধ্যের কয়েক ঘণ্টা মনে থাকবে যত দিন বেঁচে আছি। পরিশেষে ভাষা মতিনের পরিবারের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা ভালবাসা জানিয়ে তার স্মৃতির প্রতিটি কথা লালন করে আমৃত্যু দেশের কল্যানে কাজ করে যাব। ভাষা আন্দোলনে আব্দুল মতিনের অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

